গরমের এই সময়টায় ঘরে কিংবা বাইরে ঘামের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ অনেকেরই ধারণা ঘামের পরিমাণ বেশি না হলে কিংবা ঘামে কোনো দুর্গন্ধ না থাকলে হয়তো এ নিয়ে বাড়তি ভাবনার কিছু নেই। আবার সাত-পাঁচ না ভেবে গরমের ঘামকে মন্দ ভাবারও ঢের লোক আছে আশপাশের দু-চার তল্লাটে। অথচ ঘামের দুর্ভাবনাটুকু জয় করতে পারলে একটু-আধটু ঘাম ঝরানো যে মন্দ নয় সেটি চিকিৎসাবিজ্ঞানেও বেশ ভালো ভাবেই স্বীকৃত। আর তাই ঘামের উপকারিতা আর ঘাম নিয়ন্ত্রণের নানা ভাবনা নিয়েই আমাদের এবারের মূল আয়োজন। লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ
বাইরে রোদের প্রচণ্ড তেজ। তাই বাইরে বেরুলেই যে ঘেমে-নেয় বাড়ি ফিরতে হবে এ কথা আপনার বেশ ভালো করেই জানা। অতএব কী করে গরমের দিনে ফুল বাবুটি হয়ে একেবারে না ঘেমেই দিব্যি বাড়ি ফেরা যায় তাই নিয়ে সবাই মাথা ঘামান। অথচ এই মানুষটিই হয়তো জ্বরের সময় বেশ করে চাইছেন যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায় তার। কিন্তু তাই বলে গরমের এই সময়টায় ঘামের মোকাবিলা কে-ইবা করতে চায়। আর ফিটনেসের ক্ষেত্রে শরীর থেকে ঘাম ঝরানোর কথা যাও বা বলা চলে এই গরমে সেই ঘামের প্রসঙ্গ তোলাটাই এক রকম নিষেধ। তাছাড়া যেখানে গরমের ঘাম মানেই অস্বস্তি আর নানা রকমের ঝামেলা সেখানে ঘাম থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততোই তো ভালো। তবে শরীরের কলকব্জা সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও রয়েছে তারা কিন্তু ঘামকে নয়, বরং ঘামের সমস্যাটাকেই শুধু বিদায় জানাতে চাইবেন।
ঘাম নিয়ে ভাববার অনেক কিছুই আছে। তবে তার আগে জানা চাই, ঘাম কেন হয়? মূলত আমাদের যে শরীরযন্ত্র সেটি সবসময়ই শরীরের তাপমাত্রাকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে ধরে রাখতে চায়। ফলে কায়িক পরিশ্রম বা বাইরের তাপমাত্রার প্রভাবে যখন আমাদের শরীরের তাপমাত্রাও খানিকটা বেড়ে যায় তখন শারীরিক ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘামের নিঃসরণ ঘটিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করে। আর ঘামের নিঃসরণের এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশজুড়ে থাকা এক্রিন গ্রন্থি বা ঘর্মগ্রন্থির মাধ্যমে। এ কারণে যদি কেউ কম ঘামেন বা পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক কারণে যদি ঘামের পরিমাণ কম হয় তাহলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ভয়টাও বেড়ে যায়। অন্যদিকে গরমের সময় হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রধাণ কারণও কিন্তু এই শরীরের অভ্যন্তরীন তাপমাত্রা বৃদ্ধিই। কাজেই লক্ষ করলে দেখা যাবে যারা গরমের দিনে দরদর করে ঘামছেন তাদের তুলনায় একেবারে ঘাম না হওয়া মানুষটির হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হবার প্রবণতা কিন্তু অনেকাংশেই বেশি।
এ তো গেল গরমে ঘেমে যাওয়ার একটা ভালো দিক। তবে এটিই যে ঘামের একমাত্র সুফল তা কিন্তু নয়। তাছাড়া গরমের এই সময়টায় যারা সারাক্ষণই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থাকেন তাদের শরীরের তাপমাত্রাও তো আর বাড়ে না। কিন্তু এভাবে এই দলের মানুষরা হিটস্ট্রোকের হাত থেকে বেঁচে গেলেও ঘামের আরেকটি উপকার থেকে এরা ঠিকই বঞ্চিত হন। আর তা হলো ঘামের সাথে সাথে শরীর থেকে ক্ষতিকর বর্জ্য বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি। সাধারণত প্রতিবার ঘামের সাথে সাথে আমাদের শরীর থেকে যে পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পদার্থ বেরিয়ে যায় তা শরীরকে খানিকটা চাঙ্গা রাখতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ কারণে আদিম চিকিৎসা পদ্ধতিতে ঘামের বিষয়টিকেও দেখা হতো গুরুত্ব দিয়ে।
ঘামের এ ধরনের গুণগান শুনে রোজ যারা ঘামের সমস্যায় জেরবার হচ্ছেন তারা খানিকটা ক্ষেপে যেতেই পারেন। তবে ঘামের প্রতি রাগান্বিত হওয়ার চাইতে ঘামবাহিত সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগী হয়ে ওঠাই তাদের প্রধান করণীয় হওয়া উচিত। সাধারণত ঘামের এসব সমস্যার মধ্যে প্রথমেই আসে ঘামের দুর্গন্ধের কথা। আর ঘামের এই দুর্গন্ধের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি হয় বগল এবং দুই পায়ের ভাঁজে। তবে সাধারণ এক্রিন গ্রন্থির ঘামের চাইতে এই ঘামের ধরনটা ভিন্ন বলেই তা থেকে দুর্গন্ধ জন্ম নেয়। আর দুর্গন্ধের অন্যতম মূল কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। শরীরের এই অংশগুলোসহ যে কোনো স্থানে ঘামের দূর্গন্ধ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তাই সবার আগে বাগে আনতে হবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে। এজন্য প্রচলিত সাবান, ডিওডোরেন্ট বা পাউডারে যদি কাজ না হয় তাহলে ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ত্বকের ভাঁজে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া গরমে ঘাম কম হয় এমন আরামদায়ক পোশাক বা মোজা ব্যবহার করেও অনেকাংশে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এসবের পাশাপাশি নিয়মিত গোসল করা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ঘামে ভেজা কাপড় বা মোজা একটানা কয়েকদিন ব্যবহার না করা এবং বেশি ঘাম হলে খানিকক্ষণ পর পর ঘাম মুছে ফেলার মতো সহজ বুদ্ধিগুলোও কাজে আসতে পারে।
গরমে নানা কারণে বাইরে গিয়ে যারা ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যান তাদের আরেকটি বড় সমস্যা নিঃসন্দেহে ঘামাচি। ঘামাচি মূলত ঘর্মগ্রন্থিরই এক ধরনের রোগ। ঘর্মগ্রন্থির নালী অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও গরমে বন্ধ হয়ে এ রোগের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মের এ সময়টায় যখন দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণ ঘাম নিঃসরণ হতে থাকে তখন এর কিছু অংশ ঘর্মগ্রন্থিকে ছিদ্র করে ত্বকের নিচে এসে জমা হতে থাকে এবং সে স্থান ফুলে ওঠে। সেই সাথে থাকে প্রচণ্ড চুলকানি ও সামান্য জ্বালাপোড়া ভাব ও ছোট ছোট ফুসকুড়িণ্ড এটাই মূলত ঘামাচি। ঘামাচির প্রধান চিকিৎসা হলো গরম আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে ঠাণ্ডা পরিবেশে যাওয়া। এছাড়া যাদের ঘামাচির সমস্যা বেশি তারা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে হাইড্রোকটির্সোন ১ শতাংশ ব্যবহার করলে ত্বকের চুলকানি কমিয়ে আনতে পারেন। এছাড়া এনথিক্যাল লোশন বা ক্যালামাইন লোশন লাগিয়েও অনেক সময় ঘামাচির সমস্যা কমিয়ে আনা যায়। আবার গরমে যাদের ঘামের পরিমাণ স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হয় তারা এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে ২০ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড টিংচার সপ্তাহে তিনবার প্লাস্টিক গ্লাভসের মাধ্যমে ব্যবহার করে ভালো ফল পেতে পারেন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ১৮, ২০১০
Leave a Reply