পিত্তপাথর অতি বড় অসুখ। এই অসুখটি প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষের মাঝে দেখা যায়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়াসহ সর্বত্র এর বিস্তার লক্ষণীয়। সর্বাধিক দেখা যায় সুইডেনে যেখানে শতকরা হার ৩৮ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়াতে শতকরা ১৫ থেকে ২৫ ভাগ পাওয়া যায়। সর্বনিম্ন হার দেখা যায় আয়ারল্যান্ডে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ।পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এই রোগের হার দ্বিগুণ। যথাক্রমে শতকরা হার ৮৯ ভাগ থেকে ৭৩ ভাগ পর্যন্ত। আফ্রিকাতে এর হার খুবই কম যায় শতকরা হার ১ ভাগেরও কম।
পিত্তপাথরের প্রকারভেদঃ পিত্তপাথরের কারণকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে যথা
(১) পুরাতন-জনিত কারণঃ যেমন প্রদাহজনিত, মেটাবলিজমজনিত, স্থবিরতাজনিত।
(২) বর্তমান কারণ যথাক্রমে (ক) কোলেস্টরল পাথর (খ) কালো রঙের পাথর (গ) বাদামী রঙের পাথর।
(ক) কোলেস্টরল পাথরঃ শতকরা ৭৫ ভাগ পাথর এই শ্রেণীভুক্ত। সাধারণত সংখ্যায় অধিক। একটি মাত্র পাথর হলে তা বিরাট আকার ধারণ করে।
(খ) কালো রঙের পাথরঃ এই পাথর সংখ্যায় অনেক বেশী এবং ছোট আকারের হয়। সাধারণত রক্ত কণিকা ভেঙে গেলে এই রঙের পাথর দেখা দেয়। এর সাথে শতকরা ২০ ভাগ ইনফেকশন থাকে।
(গ) বাদামী রঙের পাথরঃ এই পাথর তৈরী হয় পিত্তনালীতে।
কখন পাথর হয়ঃ
(১) বয়স বাড়ার সাথে এই রোগের প্রবণতা বাড়ে।
(২) জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে পাথরের হার বৃদ্ধি পায় কম বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে।
রোগের লক্ষণ সমূহঃ
(১) পেটে ব্যথাঃ উপর পেটের মাঝখানে ও ডান পার্শ্বে ব্যথা থাকে। এই ব্যথা হালকাভাবে এবং কখনো তীব্রভাবে হয়ে থাকে। ব্যথার স্থায়ীত্ব ৩ ঘন্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত থাকে। এরপর ২ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত ভাল থাকে। অনেক সময় এই ব্যথা ডান পার্শ্বের ঘাড়ে চলে যায়। তীব্র ব্যথা হলে রোগী কোন অবস্থায় স্বস্তি পায়না এবং এর সাথে বমি থাকে ও জ্বর হয়। পেট ফাঁপা থাকে।
(২) ক্ষুধামন্দাঃ একবার খাওয়ার পর আর সারাদিন খেতে ইচ্ছে হবে না। মনে হবে পেট ভরে আছে। কোন কিছুতেই রুচি আসবে না।
(৩) জন্ডিসঃ জন্ডিস কখনো কখনো দেখা দেয়।
(৪) জ্বরঃ কখনো মারাত্মক জ্বর হয়। শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বর আসে।
জটিলতাঃ
(১) পিত্তথলির পুজ যা এমপায়েমা নামে পরিচিত।
(২) পিত্তথলির ফুটা হয়ে যাওয়া।
(৩) পিত্তথলির গ্যাংগ্রিন।
(৪) ক্যান্সার
পরীক্ষাঃ নানাবিধ পরীক্ষা পদ্ধতি রোগ নির্ণয়কে সহজ করে ফেলেছে।
চিকিৎসাঃ চিকিৎসাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
যথা-মেডিসিন ও সার্জারী।
মেডিসিন চিকিৎসাঃ পিত্তপাথর রোগীরা প্রায়ই বলে থাকেন মেডিসিন দিয়ে পাথর বের করে দেন। আসলে মেডিসিনের কোন প্রকার ভূমিকা নেই পাথর সারাবার। তাই পাথর যেভাবে ধরা পড় ক না কেন অপারেশনই একমাত্র চিকিৎসা। আর সার্জারীই একমাত্র ভরসা। এক সময় প্রচলন ছিল পাথর নির্ণয় না হওয়ার কারণে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করতো বছরের পর বছর। এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে নানাবিধ পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে তাই পাথর চিকিৎসা আর কোন সমস্যা নয়। বাজারে একটা ওষুধ চালু আছে যা দিয়ে পাথর গলিয়ে ফেলা যায় বলে সেই কোম্পানী দাবী করেছেন। আমি সেই কোম্পানির দাবীকে অযৌক্তিক মনে করছি না, তবে সেখানে যে শর্ত দেয়া হয়েছে ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা পূরণ কঠিন। তাই মেডিসিন চিকিৎসার প্রতি নিয়োজিত থেকে অযথা সময় ক্ষেপণ করবেন না।
সার্জারী চিকিৎসাঃ- অনেক প্রকার পদ্ধতি এখন প্রচলিত। (১) ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতি (২) পেট কাটা পদ্ধতি। যদি পিত্তথলির জটিলতা না থাকে তবে ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতি সেরা। তবে তা হতে হবে বিশেষজ্ঞের হাতে। আজকাল যত্রতত্র এই পদ্ধতি চালু হয়েছে। অনভিজ্ঞ, আধা-অভিজ্ঞ সার্জন এই চিকিৎসার আয়োজন করছে। তাতে জটিলতা প্রচুর বাড়ছে। যথেষ্ট অভিজ্ঞ না হয়ে এই মেশিন কখনোই ব্যবহার করবেন না। আর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না হলে তার কাছে সার্জারী করাবেন না। তাতে কষ্ট বাড়বে, পয়সা খরচ বেশী হবে, জটিলতা বাড়বে। ইদানিং প্রায়ই শোনা যাচ্ছে রোগীদের বক্তব্য ল্যাপারোস্কপিক করলে আবার পেট কাটা লাগে। কথাটা যথেষ্ট সত্য। আমাদের দেশের পরীক্ষা পদ্ধতি ক্রটিপূর্ণ। আলট্রাসাউন্ড রির্পোট নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। অভিজ্ঞ আলট্রাসাউন্ডদের হাতে সারা বিশ্বে সফলতার হার শতকরা ৭০ ভাগ। আমাদের দেশে এই হার আরো কম।
তাই প্রায়ই ভুল হয়। এই সেদিনও পিজি হাসপাতালে এক মহিলার আলট্রাসাউন্ড বিশ্বাস করে ল্যাপারোস্কপিক করতে যেয়ে ব্যর্থ হতে হলো। আলট্রাসাউন্ড বর্ণনার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। সাথে সাথে পেট কাটা হলো এবং দেখা গেল পিত্তথলিতে তো পাথর আছে পাশাপাশি পিত্তনালীতেও পাথর আছে। যদি ঐ সময় পেট কাটা না হতো তাহলে এই রোগীও দ্বিতীয়বার সার্জারী লাগতো। তবে সঠিকভাবে শুধুমাত্র ল্যাপারোস্কপিক সার্জারী দ্বারা একমাত্র সার্জারী করা যাবে যদি রুটিনভাবে ইআরসিপি করে নেয়া যায়। এই প্রথা আমাদের দেশে আমি চালু করার পক্ষে অতিমাত্রায় সোচ্চার। এতে সময় বাঁচবে,পয়সা বাঁচবে রোগীদের দ্বিতীয়বার অপারেশনের ঝুঁকি থাকবে না। উন্নত বিশ্বের সব দেশে এই প্রথা চালু হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে তারা এই প্রথার পরীক্ষা ছাড়া ল্যাপারোস্কপিক করে না। ইআরসিপির আরো একটি ভাল দিক আছে। যেমন পেরিএমপুলারী ক্যান্সার শুরুতেই নির্ণয় করা যায়।
পিত্তথলিতে াজ জমে আছে, পিত্তথলির আয়তন বড় হচ্ছে, ডান পার্শ্বের হাতে চাকা লাগছে, সামান্য ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ল্যাপারোস্কপিকের সাহায্যে অথবা পেট কেটে পিত্তপাথর অপারেশন করা হয়েছে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ীতে গিয়েছে। ১-২ মাস পর পুনরায় জন্ডিস নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন। এবার পরীক্ষা করে ধরা পড়ল প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার। লিভার ও অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। কি নির্মম, অথচ ইআরসিপি করা হলে শুরুতেই ঐ রোগ ধরা পড়ত। আসল চিকিৎসা সম্ভব হতো। রোগীর অকাল মৃত্যু হতো না। সুতরাং সাবধান যত্রতত্র অপারেশন পরিত্যাগ করুন, বিশেষজ্ঞদের কাছে সঠিক উপদেশ নিন ও সঠিক চিকিৎসা করুন।
—————————–
দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুন ২০০৮
প্রফেসর ডাঃ মোঃ সহিদুর রহমান
বিভাগীয় প্রধান
হেপাটোবিলিয়ারী, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারী বিভাগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ,ঢাকা।
Leave a Reply