ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারী এখন বাংলাদেশে হচ্ছে। গত ২-৩ বৎসর যাবৎ সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে এই সার্জারি শুরু হয়েছে এবং রোগীরা এর সুফল পাচ্ছেন। দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। হাজার হাজার শিশু এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারীর কল্যাণে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাচ্ছে। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের ইতিহাস প্রায় ২০০ বৎসরের পুরাতন। আলেসান্দা ভল্টা যিনি ইলেকট্রিক ব্যাটারীর আবিষ্কারক তিনিই এ বিষয়ে প্রথম কথা বলেন। উইলিয়াম হাউস ১৯৬৯ সালে সর্বপ্রথম মানুষের কানে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের সুপারিশ করেন এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তিনজন রোগীর সফল ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি করেন। ১৯৭৮ সালের ১ আগস্ট তারিখ মেলবোর্নের অধিবাসী রডসুন্দরসের কানে বিশ্বে প্রথম মাল্টি চেনেল ইমপ্ল্যান্ট লাগান হয়। একজন বধির শিশুর সবময়ই বোবা হয়। সে কথা বলতে পারে না। কারণ কথা বলার জন্য কথা শিখতে হয় আর এ শিখার জন্য শোনার প্রয়োজন হয়। যে শুনতে পায় না সে শিখতে পারে না, আর না শিখতে পারলে বলতে পারে না।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো মানুষ কানের মাধ্যমে শুনতে পায়। কানের তিনটি অংশ থাকে, বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ। অন্তঃকর্নে থাকে একটি মেশিন যার নাম ককলিয়া। এটা দেখতে অনেকটা শামুকের মত। বাইরের শক্ত হাড়ের ভিতর থাকে অতি সংবেদনশীল মেমরেনাস ককলিয়া। এটাই শোনার প্রধান কাজ করে। বহিঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণ শব্দকে পরিবেশ থেকে ধারণ করে তা ককলিয়ায় পাঠায়, ককলিয়া এইসব শব্দ থেকে প্রয়োজনীয় শব্দকে বাছাই করে প্রক্রিয়াজাত করে কানের নার্ভে প্রেরণ করে এবং নার্ভের মাধ্যমে শব্দ ব্রেইনের শ্রবণ এলাকায় যখন পৌঁছে তখন মানুষের মস্তিষ্কে একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয় এবং সেটাই শ্রবণ এবং এই অনুভব তার স্মৃতিশক্তিতে জমা হয়। এই শব্দ যখন আবার মস্তিকে পৌঁছায় তখন স্মৃতিশক্তি বলে দেয় এই শব্দের অর্থ কি। এই ভাবেই মানুষ ভাষা শিখে। যে জন্য শিশু ছোটবেলা যে পরিবেশে থাকে সেই ভাষাই শেখে যেমন জঙ্গলে থাকলে সে পশুর ডাক শিখে। এই ককলিয়া যাদের তৈরি হয় না বা নষ্ট হয়ে যায় তখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং শিশুরা শুনতে পায় না, ফলে ভাষা শিখতে পারে না। এই ককলিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার নামই হলো ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। বিশেষ ইন্দ্রিয় যেমন শ্রম্নতি, দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ এর মধ্যে শুধু শ্রুতিকেই এ পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এটা একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। এর বিস্ময়কর ক্ষমতার জন্য একে বায়োনিক কানও বলা হয়।
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের কয়েকটি অংশ থাকে। এর কিছু কানের ভেতরে সার্জারির মাধ্যমে লাগিয়ে দেয়া হয় আর কিছু অংশ কানের বাইরে থাকে। একটি চুম্বক জাতীয় বস্তু ভেতরের যন্ত্রের সাথে বাইরের যন্ত্রের সংযোগ রক্ষা করে। একটি মাইক্রোফোন থাকে যা বাইরের শব্দকে সংগ্রহ করে। স্পীচ প্রসেসর এই সংগৃহীত শব্দকে প্রক্রিয়াজাত করে কানের ভেতরের প্রতিস্থাপিত রিসিভারে পাঠায়, এই রিসিভার থেকে একটি সূক্ষ্ণ তার ককলিয়ার হাড়ের ভেতর পৌঁছে যা রিসিভার থেকে শব্দকে কানের নার্ভে পৌঁছে দেয়। নার্ভ এই শব্দ তরঙ্গকে ব্রেইনের শ্রম্নতি এলাকায় পৌঁছায় তখন মানুষ শুনতে পায়। একটি চুম্বক জাতীয় ট্রান্সমিটার বাইরের যন্ত্রের সাথে ভেতরের যন্ত্রের সংযোগ রক্ষা করে। বাইরের যন্ত্রের জন্য ব্যাটারী দরকার হয়।
কাদের জন্য এই সার্জারী প্রয়োজনঃ যে শিশুর জন্মের সময় ককলিয়ার তৈরি হয়নি বা জন্মের পরে ককলিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে তাদের জন্য এই অপারেশন অপরিহার্য। আরেক গ্রুপ আছে যারা জীবনের কোন পর্যায়ে হঠাৎ করে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছে তাদের শ্রবণ শক্তি ফিরিয়ে দেবার জন্য এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট জরুরী।
যে শিশু জন্ম থেকেই বধির তাকে ২ বৎসরের পূর্বে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি লাগিয়ে দিলে স্বাভাবিক নিয়মে সে বড় হতে থাকে এবং ভাষা শিখতে থাকে। তাহলে সে খুবই উপকৃত হবে এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেতে পারবে। ২-৫ বৎসর সময়টা শিশুর ভাষা শেখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে ব্রেইন ভাষা শিখার কাজটি সম্পন্ন করে। এই সময়ে যদি শিশুকে শোনার ব্যবস্থা না করা হয় তবে শিশুর ভাষা শিখানো কঠিন হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে অনেক নামী-দামী লোক আছেন যারা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি মিস এমেরিকা ১৯৯৫, একজন ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি। ব্রিটিশ কয়েকজন এমপি আছেন যারা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টি।
ব্রেইনের নির্ধারিত শ্রুতি এলাকায় যদি কোন ইনপুট অর্থাৎ শব্দ না দেয়া হয় তবে আউটপুট অর্থাৎ ভাষা শেখা সম্ভব হয় না। তাছাড়া শ্রুতি এলাকায় ইনপুট না পৌঁছালে অন্য এলাকার ইনপুট সেটা দখল করে নেয় যেমন দৃষ্টির এলাকা বিস্তৃত হতে পারে শ্রুতির এলাকা পর্যন্ত। সে জন্য দেখা যায় শ্রম্নতি প্রতিবন্ধীদের দৃষ্টি খুবই প্রখর হয় এবং অনেক শ্রুতি প্রতিবন্ধী দেখেই মানুষের ছবি একে দিতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ঘোড়ার বাচ্চার ব্রেইনে একটি প্রোগ্রাম থাকে জন্মের পরই সে দাঁড়াবে এবং কিছুক্ষণ পরই সে দৌড়াতে পারবে। এই বচ্চাটিকে যদি জন্মের পর পর পায়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে ৪ সপ্তাহ শুইয়ে রাখা হয় তবে সেই ব্যান্ডেজ খেলার পর আর সে হাঁটতে পারবে না কারণ ততদিনে তার ব্রেইনের হাঁটার প্রোগ্রাম মুছে গেছে এবং অন্য প্রোগ্রাম এটা দখল করে নিয়েছে। সেজন্যেই বাচ্চাদের ২-৫ বৎসরের মধ্যে অপারেশন করানো জরুরী। এরপর অপারেশন করালে শব্দ শুনতে পেলেও সে শব্দের অর্থ বুঝা এবং ভাষা শিখা খুব একটা সহজ হয় না। ব্রেইনের এই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ শেখার ক্ষমতাকে বলা হয় নিউরাল প্লস্টিসিটি।
অন্য আরেকটি গ্রুপ আছে যা স্বাভাবিক কথা শেখার পর হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছে তাদের জন্য এই অপারেশন অপরিহার্য এবং এটা যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভাল। বেশি দেরী হলে শেখা কথা এক সময় ভুলে যায়। ৬ মাসের মধ্যে হলে ভাল হয়।
কি কারণে শিশুরা বধির হয়ঃ প্রকৃতির খেয়ালে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একজন জন্মগ্রহণ করে জন্মবধির হয়ে জেনেটিক কারণে শিশুর ককলিয়া তৈরী হয় না। বিশেষ করে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে এই সমস্যা দেখা দেবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া গর্ভকালীন সময়ে মা যদি রুবেলা, হাম, মামপস বা এই জাতীয় ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় বিশেষ করে গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে, তবে ককলিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রসবকালীন সময় যদি লম্বা হয়, জন্মের পর যদি বাচ্চার অক্সিজেন কমে যায়, যদি খিচুনী হয় বা মোনজাইটিস হয় তাহলে ককলিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছোট শিশুদের মারাত্মক ডায়রিয়া ও শিশুকে বধির করে দিতে পারে। এসব প্রতিরোধযোগ্য। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে না দেয়া, সময়মত মা ও শিশুকে ক্ষতিকর ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা দেয়া, জ্বর হলে জ্বরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডায়রিয়ার সঠিক চিকিৎসা করা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকলে এই শিশু বধিরতা কমে আসবে।
অন্যরা কেন বধির হয়ঃ সাধারণ ঠান্ডা সর্দি ও ভাইরাস, রুবেলা, মামপস, হাম ইত্যাদি ভাইরাস ককলিয়া নষ্ট করে দেয় তাছাড়া যদি কোন কারণে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তখন ককলিয়া অক্সিজেন পায় না এবং এতে করে ককলিয়া মরে যায়। তখন ককলিয়া নষ্ট হয়ে যায় ফলে মানুষ সম্পূর্ণ বধির হয়ে যায়। কোন দুর্ঘটনার জন্যও ককলিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া কোন কারণ ছাড়াই ককলিয়ার হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যেতে পারে। যার কোন কারণ মানুষ খুঁজে পায় না। শুধু বুঝতে পারে হঠাৎ করেই কান দুইটি নষ্ট হয়ে গেছে চিরতরে।
এই অপারেশনের জন্য কি প্রয়োজনঃ রোগীকে স্বাভাবিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। একটি ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট টিম থাকবে যে টিমের নেতৃত্ব দিবেন একজন দক্ষ নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, একজন নিউরোলজিস্ট, একজন বধিরদের শিক্ষক, একজন সাইকোলোজিস্ট, একজন স্পীচ থেরাপিস্ট এবং একটি পূর্ণাঙ্গ অডিওলজিক্যাল সেন্টার এবং ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। এটা খুবই দামী। এমেরিকায় এই সার্জারির ব্যয় হয় ৪৫ হাজার থেকে ১০৫ হাজার ইউএস ডলার, পার্শ্ববর্তী দেশে খরচ ১৫-১৮ লাখ টাকা আর বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে খরচ পড়ে ৯-১২ হাজার ইউএস ডলার অর্থাৎ সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা। এখানে শুধু ইমপ্ল্যান্টের দামটি নেয়া হয় বাকি সব খরচ ফ্রি।
দেশের প্রতিষ্ঠিত নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞগণ এই চিকিৎসাকে সহজলভ্য করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা সরকারিভাবে প্রথম মিটফোর্ড হাসপাতালে সফলভাবে এই অপারেশন করেছি। আরো চারজন রোগী অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই অপারেশনের মাধ্যমে শ্রুতিপ্রতিবন্ধীরা হয়ে উঠবে সরব, কর্মক্ষম। বাইপাস সার্জারির মত ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারিও একদিন সহজলভ্য হবে, বধিরতার চিকিৎসায় নবদিগন্তের সূচনা করবে।
উৎসঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ০৯ ডিসেম্বর ২০০৭
লেখকঃ ডাঃ মোঃ আবু হানিফ
সহযোগী অধ্যাপক, নাক, কান, গলা বিভাগ,
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা।
Leave a Reply