দীপ্তি নিজের অস্তিত্বে আবিস্কার করলো অন্য এক অস্তিত্বকে। তিল তিল করে বেড়ে ওঠা সেই অস্তিত্বই দীপ্তিকে জানান দিল তুমি মা হতে চলেছ। অপ্রতিরোধ্য এক শিহরণ প্রতি মুহূর্তে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দীপ্তিকে। মা হয়ে ওঠার এ প্রক্রিয়ায়, আনন্দ আর অবেগের সম্মিলনে দীপ্তির চোখের সীমা অতিক্রম করে নোনা জল। তবে এ অশ্রুর মাজেজা কেবল গর্বের নয়, অনেকটা মর্ম পীড়া উপলব্ধি করারও। কারণ একটি প্রাণকে নিজের ভেতর ধারণ করতে গিয়ে দীপ্তি অনুভব করতে পারছে কতটা কষ্টের নদী পাড়ি দিয়ে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন। বিনিময়ে মাকে মুঠো মুঠো অযৌক্তিক অভিমান আর কষ্ট দেয়া ছাড়া কিছুই তো দেয়া হয়নি। দীপ্তির মনে পড়ে মা তার শত পাগলামী আর অনাচার চোখ বুঝে সহ্য করে কেবল মুখ থেকে একটি বাক্যই উচ্চারণ করতেন, ‘যখন মা হবে তখন বুঝবে’। আজ সেই দিন এসেছে। বুঝতে পারার দিন। দীপ্তির এখন প্রায়ই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘মাগো, ক্ষমা কর আমাকে। তোমার এ ছেলে মানুষ মেয়েটিকে ক্ষমা কর।’ মায়ের সেই আদর আর ভালোবাসার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছর বিশেষভাবে স্মরণ করার এক দিন ফিরে আসে। প্রতি মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় মা দিবস। মায়ের ভালোবাসা এক দিবসে কেন লক্ষ দিবসেও পূর্ণ করার নয়। তবুও বিশেষভাবে স্মরণ করার এই দিনটিতে হয়তো আমরা মায়ের জন্য কিছু প্রাপ্তি রেখে যেতে পারি। তাই নিয়ে লিখেছেন মোর্শেদ নাসের
রাগিব যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন রাগিবের বাবা মারা যান। বাবার আদর কি, তা বোঝার আগেই রাগিব বাবাকে হারিয়ে ফেলে। তবে মায়ের স্নেহ ও শাসন কখনোই রাগিবকে বুঝতে দেয়নি বাবার অনুপস্থিতি। বাবার মৃত্যুর পর মা হয়তো নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতেন কিন্তু রাগিবের কথা চিন্তা করে নতুন করে কিছুই করা হয়নি তার। অথচ সময়ের প্রয়োজনে, জীবনের এক প্রান্তে এসে রাগিব নতুন জীবন শুরু করেছে। আর এ নতুন জীবনে ক্রমশই যেন মা হয়ে উঠছেন জীর্ণ আর অপ্রত্যাশিত কেউ। মা বুঝতে পারছেন যে রাগিব এক সময় মা বলতে অজ্ঞান ছিল সে রাগিবের কাছে মায়ের প্রয়োজন আজ ফুরিয়ে যেতে বসেছে। এক বুক অভিমান নিয়ে মা তাই সিদ্ধান্ত নিলেন বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন।
সিলভিয়া মাঝে মাঝে ভাবে মার বোধ হয় দশ হাত আছে। দুটি হাত খালি চোখে দেখা যায় আর বাকি আটটি চোখে দেখার সামর্থ্য তার নেই। তবে সিলভিয়া দিব্যি অনুভব করতে পারে অদৃশ্যমান হাতগুলোকে। সিলভিয়া দেখে তার মার সকাল হয় কাক ডাকা ভোরে। ঘুম থেকে উঠেই সকালের নাস্তা তৈরি করেন, দুপুরের রান্না সারেন, সিলভিয়ার স্কুলের টিফিন তৈরি করে বক্সে পুরে দেন। এছাড়া বাজার করা, পানির বিল, গ্যাস বিল পরিশোধ, দাদুর ঔষধ খাওয়ান, বাবার অফিসের কাগজ সামলিয়ে রাখা আরো কত কি যে মাকে করতে হয়! ঘরের এত সব কাজ সামলিয়ে মা ছুটেন অফিসে। সারাদিন অফিসের কাজ করে বাড়ি ফিরেও কি মার শান্তি আছে। আবারো সেই কাজের সমুদ্রেই ডুব দিতে হয় মাকে। সিলভিয়া যখন মা হবে তখন তাকেও মায়ের মতই এমন কর্মী হতে হবে।
এসব টুকরো টুকরো গল্পগুলোতে যেমন ভিন্নতা রয়েছে তেমনি রয়েছে সাদৃশ্যও। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্মোহ আর নিষ্কলুষ সম্পর্কের নাম ‘মা’। সন্তানের প্রতি মায়ের অপার স্নেহের নমুনা যুগে যুগে কালে কালে একই রকম। সময়ের মারপ্যাচে সব সম্পর্কই রঙ বদলায়, পরিবর্তন করে চরিত্র। একমাত্র ‘মাতৃত্বের’ সংজ্ঞারই নতুন সংস্করণ কিংবা পরিবর্ধন হয় না। সন্তানের মঙ্গল কামনায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটে তার। যদিও জীবনের বাঁকে সন্তানের কাছ থেকে স্নেহের বিনিময়ে হয়তো অবহেলাই জুটে। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা এতই অন্ধ যে সন্তানের শত ভুলের মাশুল দিতে ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় থেকে ঝরে কেবল আশীর্বাদ। সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগের গল্প নতুন কিছু নয় বরং স্নেহের চাদরে মোড়া মায়ের আদরের ছায়ায় লালিত সন্তানরাই মাঝে মধ্যে ভুলে যান মায়ের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের কথা। অথচ এ ভুবনের আলো গায়ে জড়িয়ে যে সন্তানরা হাঁটা-চলা করছেন তাদের মনে রাখা প্রয়োজন এ গর্বের নেপথ্যে রয়েছে মায়ের ১০ মাস ১০ দিনের দীর্ঘ সাধনা। এ সাধনার ঋণ ইহজগতে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই কেবল ‘মা দিবস’ এ নয় মায়ের প্রতি ভালোবাসার ব্যারোমিটার উর্ধ্বমুখী থাকুক সব সময়। তবে এ দিনটিতে নতুন করে উচ্চারিত হোক প্রতিটি সন্তানের মুখে ‘আমার মা আমার ভুবন’।
মা দিবসের জন্ম কথা
মা দিবসের আদি উৎপত্তি খুঁজতে চলুন মানব সভ্যতার তীর্থভূমি প্রাচীন গ্রিসে যাই। গ্রিক সভ্যতায় প্রতি বসন্তে ‘মাদার অব গড’ রিয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ একটি দিন উদযাপন করা হতো। তবে ধর্মীয় উৎসব থেকে মা দিবস সামাজিক উৎসবে পরিণত হয় ১৬০০ শতাব্দীতে। সে সময় ইংল্যান্ডে মায়ের সম্মানে ‘মাদারিং সানডে’ নামে একটি বিশেষ দিন উদযাপিত হতো। শুরুর দিকে এই রীতি। (না, তখনো ‘উৎসব’ লেখার মতো পরিস্থিতি হয়নি) শহরের বিত্তবানদের মধ্যেই বন্দি ছিল। কাজের সন্ধানে এ সময় গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসে শহরে। শহুরে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের। সে সঙ্গে মা দিবসেরও। বিশেষ দিনটিতে গৃতকর্তারা তাদের ভৃত্যদের ছুটি মঞ্জুর করে, যাতে তারা মায়ের সঙ্গে দিনটি উদযাপন করতে পারে।
দিবসটি আরো সর্বজনীন করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জুলিয়া ওয়ার্ড। ১৮৭২ সালে দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি ব্যাপক লেখালেখি করেন। তবে দিবসটিকে একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক নারী। ১৯০৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার অ্যানা জার্ভিস দিবসটিকে স্বীকৃতি দিতে ব্যাপক প্রচার চালান। ওই বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ছিল তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। অ্যানা সেই দিনটিতেই মা দিবস পালন করেন। পরের বছর পুরো অঙ্গরাজ্যে পালিত হয় মা দিবস।
জাতীয় মা দিবস ঘোষণার জন্য অ্যানা আর তার সমর্থকরা মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯১৪ সালে তাৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দিবসটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মে ০৪, ২০১০
Leave a Reply