বাইরে রোদের তেজটা বহুদিন ধরেই বড্ড বেশি। তার ওপর এই শহর ঝঞ্জাটে ধুলা-ধোঁয়ার চিরন্তন উপদ্রব তো রয়েছেই। এসব থেকে রাতারাতি নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়ার উপায় হয়তো বাতলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে রোদ আর ধুলা-ধোঁয়ার উপদ্রব থেকে আপনার মহামূল্যবান চোখ দু’খানাকে সহজেই বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে একটি রোদ চশমার বদৌলতে। আমাদের এবারের আয়োজনে রইল রোদ চশমারই নানা দিকের কথা। লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার ছেলেবেলা’য় উদ্ধৃত চাকর সর্দার ব্রজেশ্বরের কথা নিশ্চয়ই এখনও অনেকের মনে আছে। খানিকটা শুচিবাইগ্রস্থ এই ব্রজেশ্বরের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিগুরু এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাসা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাতবার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ করে দিত ডুব। স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বর এমন ভঙ্গিতে হাত বাঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বাঁচে।’ ব্রজেশ্বরের সেই কাল বহু আগেই গেছে। তবে পৃথিবী থেকে সকল জঞ্জাল আর ধুলা-ধোঁয়া যে রাতারাতি উবে গেছে, তা তো আর নয়। আর তাই এ যুগেও আমাদের প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হতে হয় হরেক রকম ঝক্কি-ঝামেলার। নগরজ্যামে কখনো যেমন বিষাক্ত বাতাসে দম বন্ধ হবার যোগার হয় তো পরক্ষণেই হয়তো চোখের মাঝে যন্ত্রণা তৈরি করে রাজ্যের ধুলা। তবে অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে মনোযোগটা যদি থাকে স্রেফ চোখজোড়ার প্রতি, তাহলে এই ঝক্কির খানিকটা হলেও হয়তো কমতে পারে রোদ চশমা কিংবা সানগ্লাসের বদৌলতে।
এখন সময়টাই বড্ড কেতাদুরস্ত হয়ে চলার। আর তাই আমজনতার চোখে রোদচশমা যতটা না চোখকে বাঁচানোর উপকরণ তার চাইতে ঢের বেশি যেন আরেক প্রস্থ স্টাইলের অনুষঙ্গ। স্টাইলের খাতিরে হলেও যারা তাদের কপালের খানিকটা নিচে আর চোখের উপরে রোদ-চশমা এঁটেছেন তারা জানা-অজানায় চোখের উপকার বৈ অপকার করেননি। এর কারণটাও বেশ স্পষ্টণ্ড বিশ্বের তাবত বিজ্ঞানী বহুদিন থেকেই বেশ উচ্চেস্বরেই বলে আসছেন রোদের ক্ষতিকর নানা দিকের কথা। তবে বিজ্ঞানীদের সেই কথা এখনো যাদের কান অবদি পৌঁছেনি তাদের নতুন করে জানিয়ে দেয়া ভালো যে, সূর্যের আলোয় যে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থাকে তা ক্রমে ক্রমে আমাদের সংবেদনশীল চোখের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া অতিরিক্ত ধুলো-ময়লা চোখে ঢোকার ফলে চোখে তৈরি হতে পারে মারাত্মক প্রদাহ। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে চোখ অতিমাত্রায় শুষ্ক হয়েও ঘটাতে পারে নতুন বিপত্তি। আবার যারা প্রখর সূর্যালোকে সারা দিনমান বাইরে ঘুরে বেড়ান, রোদের আলোয় তাকাতে গিয়ে তাদের কপালে তৈরি হয় ভাঁজ, যা থেকে দীর্ঘমেয়াদে তৈরি হতে পারে রূপ-সৌন্দর্য্যের জন্য হানিকর বলি রেখাও। অথচ এতসব সমস্যা কিন্তু অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যেতে পারে একটি মানসম্পন্ন রোদ-চশমার বদৌলতে। তার উপর, এ দিয়ে যখন ফুটিয়ে তোলা সম্ভব আপনার স্টাইল স্টেটমেন্টটাও তখন রোদ-চশমাকে হ্যাঁ বলার জন্য আপনি নিজের মতো করে একটি আন্দোলনও চাইলে করতে পারেন।
কথিত আছে, বসে বসে মারামারি দেখতে ভীষণ পছন্দ করতেন রোমান সম্রাট নিরো। আর মারামারিটা যদি হতো নিজের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের মধ্যে, তাহলে তো কথাই ছিল না। পলিশ করা, রত্নখচিত এক ধরনের গ্লাসের ভেতর দিয়ে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন সেই মারামারি! হাল ফ্যাশনের রোদ-চশমার জন্মটা ওখান থেকেই। তবে চশমা হিসেবে এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয় সম্ভবত চীনে ১২ শতকের গোড়ার দিকে। প্রথম দিকে রোদ-চশমার লেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হতো এখন জানালার শার্শিতে যে ঘোলাটে সিলিকন কাচ ব্যবহার করা হয় সেটাকে। সে চশমার কোনো পাওয়ার না থাকলেও রোদের তীব্রতা থেকে চোখ ঠিকই রেহাই পেত। এছাড়া চীনে আদালতের বিচারকরা এ ধরনের চশমা ব্যবহার করতেন বলেও জানা যায়। তারা যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কোনো সাক্ষীকে জেরা করতেন তখন সাক্ষী যাতে তার চোখ-মুখের প্রকাশভঙ্গি দেখতে না পায় সেজন্যই নাকি এ ধরনের চশমা ব্যবহার করা হতো। অন্যদিকে রোদ চশমায় নানারকম লেন্সের ব্যবহার শুরু হয় ১৮ শতকের মধ্যভাগে জেমস আয়েসকফের মাধ্যমে।
এত গেল রোদচশমার গুনাগুন আর ইতিহাসের কথা। কিন্তু বর্তমানের এই চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে যখন নিজের চোখখানা বাঁচাতে আর ধোপদুরস্ত স্টাইল স্টেটমেন্ট গড়ে তুলতে আপনার চাই একখানা, তখন করণীয় কী? এক্ষেত্রে প্রথমেই চোখের যত্ন নেবে এমন রোদ-চশমার কথা বলি। সাধারণত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে চোখকে রক্ষা করতে আপনাকে এমন একটি রোদ চশমা বা সানগ্লাস বেছে নিতে হবে যেটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি’র শতভাগ প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করতে সক্ষম এমন রোদ-চশমার কোনো আন্তর্জাতিক মান না থাকলেও রোদ-চশমাটি কোন দেশের তৈরি সেটি থেকে এর ক্ষমতা সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে পারেন। উদহারণস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ায় এই রেটিংটি করা হয় শূণ্য থেকে চার এর মধ্যে, ইংল্যান্ডে শূন্য থেকে সাত-এর মধ্যে, আর আমেরিকায় ইউভিবি ২৮০ থেকে ৩৮০ ন্যানোমিটার র্যাংকিংয়ে মাধ্যমে। তবে অত হিসেবের যোগ-বিয়োগে যারা যেতে চান না, তারা বিক্রেতার কাছ থেকে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হবার চেষ্টা করুন যে আপনার রোদ-চশমাটি আপনার চোখ দু’টাকে আদৌ রক্ষা করতে পারবে কি না। অন্যদিকে চোখ বাঁচানোর পাশাপাশি যাদের কাছে রোদ-চশমা’র স্টাইলটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ তারা রোদচশমা কেনার সময় অবশ্য-অবশ্যই আপনার মুখের গড়নখানা মাথায় রাখুন। উদহারণস্বরূপ, যাদের মুখের আকার খানিকটা গোলাকার তাদের সাধারণত লম্বাটে ফ্রেমের রোদচশমাতেই দারুণ মানিয়ে যায়। সেই সাথে আয়তাকার বা কোনা উঁচু ফ্রেমও কমবেশি ভালো লাগে। অন্যদিকে যাদের মুখের আকৃতি আয়তাকার অর্থাৎ মুখের নীচের অংশ কৌণিক ও চোয়াল শক্ত তাদেরকে ওভাল ফ্রেমের রোদ-চশমাতেই বেশি মানাবে। আবার গালের হাড় উঁচু, কপাল চওড়া, চোয়াল অপেক্ষাকৃত চাপা হলো গোলাকৃতির রোদ-চশমায় ভালো দেখাবে। আর যাদের মুখের গড়নটাই খানিকটা ওভাল শেপ তারা একটু দেখে শুনে যে কোনো ধরনের ফ্রেমের রোদ-চশমাই পড়তে পারেন। অন্যদিকে রোদ-চশমার লেন্সের ক্ষেত্রে মানানসই যে কোনো রঙ বা স্বচ্ছ গ্লাস, যা-ই বেছে নিন না কেন সেটি যদি স্যাফায়ার ক্রিস্টালের হয় তাহলে ভালো হয়। কারণ এ ধরনের লেন্সে সহজে আঁচড়ের দাগ পড়ে না বলে সেটি বহুদিন নতুনের মতোই দেখায়। আর আমাদের দেশে এ ধরনের রোদ-চশমা পেতে ঢুঁ মারতে পারেন যে কোনো চশমার দোকান, অভিজাত বিপণি কিংবা বসুন্ধরা সিটি মার্কেটে।
কড়চা’র এই আয়োজনে মডেল হয়েছেন এ্যানি ছবি জিয়াউদ্দিন আলম
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২৭, ২০১০
Leave a Reply