আধো আধো বুলি। ছোট ছোট পা। ঘরময় বিচরণ ছোট্ট মেয়েটির। পুতুল আর রান্নাবান্নার খেলা পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। দুরন্ত শৈশব কাটিয়ে পা দেয় কৈশোরে। হতে থাকে তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন। চারপাশের জগৎটাকে অনেক বড় লাগে মেয়েটির। চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণায় আসে নতুনত্ব। তখন হঠাৎই নিজের কিশোরী মেয়েটিকে অচেনা লাগে মায়ের। এই কী আমার সেই মেয়ে! অভিভাবকেরা এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না। ইঁচড়েপাকা মনে করে অনেক ক্ষেত্রেই। মেয়েটিও তার মনের কথা কাউকে খুলে বলতে পারে না। দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতরে সে আশ্রয় খুঁজে নেয় পরিবারের বাইরে। হয়ে পড়ে মোহগ্রস্ত। অনেকেই তখন ভুল করে। বিপদে জড়িয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই। বয়ঃসন্ধিকালের এ সময়টাতে একটি মেয়ের কাছের বন্ধু হতে পারেন একজন মা। মা-মেয়ের বন্ধুত্ব এক নিমিষেই করতে পারে হাজারো সমস্যার সমাধান।
এ জন্য মাকেই প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে হবে। জানালেন নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের। ‘এ বয়সে মেয়েদের স্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন আসে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। নিজের মতো থাকতে চাইবে। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে। এসব আচরণ মায়েরা মেনে নিতে পারেন না। অকারণে তাদের সঙ্গে রাগারাগি করেন। যে কারণে মা-মেয়েতে ভালো বোঝাপড়া থাকতে হবে। কোনো কিছু নিয়ে মেয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারে। তখন তাকে বুঝিয়ে বলুন। এই বন্ধুত্বে আস্থা আর বিশ্বাস অনেক জরুরি। মায়ের ওপর আস্থাশীল হলে তার কথা গোপন করার প্রবণতা কমে যাবে। যেকোনো কথাই সে আলোচনা করবে। সমস্যা কম হবে। ভুল করলে মা ধরিয়ে দিতে পারবেন। তবে সেটি নিয়ে অন্য কারও সঙ্গে সমালোচনা করা উচিত নয়।
এতে করে তার বিশ্বাসের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যাবে। তখন বন্ধুত্বের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হবে, যা সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তাই ওর মনের কথাটি বোঝার চেষ্টা করুন। এতে সে-ও অনুভব করবে মাকে। বুঝতে পারবে, মা তাকে বোঝার চেষ্টা করছেন। মানসিকভাবে দৃঢ় হবে সে। পরিবার সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ তার মধ্যে তৈরি হবে। এভাবে সে নিজের ভালো-মন্দ বিচার করতে শিখবে। ব্যবহারেও পরিবর্তন আসবে। বয়ঃসন্ধিকালের সংকোচ, জড়তা কেটে যাবে। খেয়াল রাখতে হবে, মেয়েটি ভুল সিদ্ধান্ত নিল কি না। পরিমিতিবোধটি তৈরি করুন সন্তানের মধ্যে। প্রতিটি কাজের ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরুন। সিদ্ধান্ত নিতে দিন তাকে। দেখবেন, সে ভালো দিকেই পা বাড়িয়েছে। বন্ধুত্ব তো এমনই হওয়া উচিত।’ বলেন সারা যাকের। নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ ও তাঁর মেয়ে অপরাজিতা মুস্তাফার সম্পর্কটা চমৎকার। ছুটির দিনে তাঁরা একসঙ্গে ঘর সাজান। সময় পেলেই মা-মেয়েতে আড্ডা চলে। মায়ের নাচের অনুষ্ঠানে অপরাজিতার যাওয়া চাই-ই। খুব ভালো লাগে তার। এ বিষয়ে মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘বন্ধু হতে হলে মাকে একটু কৌশলী হতে হবে। সন্তানের চাহিদার কথা জানতে হবে। মনের কথা মায়ের মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত, যাতে করে সে অসহায় বোধ না করে। আমি মেয়ের সবকিছুতে বিরোধিতা করি না। আবার সবটাই যে শুনি তা-ও নয়। প্রতিটি বিষয়ের ভালো-মন্দ দিক আলোচনা করি। তখন সে নিজেই বিচার করতে পারে। কয়েক দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মেয়েকে জিন্স-ফতুয়া পরতে নিষেধ করলাম। তবুও সে পরে গেল। সেখানে গিয়ে সে বুঝতে পারে পোশাকটি ওই পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়। তখন সে বুঝতে পারল, কেন মা নিষেধ করেছিলেন। মেয়েকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার চেষ্টা করি, যাতে সে একাকি বোধ না করে। সন্তানের কাছাকাছি থাকলে তাকে বোঝাও সহজ হয়। পর্যবেক্ষণ করা যায়। এ বয়সে সন্তানের ভুল করার আশঙ্কা বেশি। চোখে সবই ভালো লাগে। বাড়াবাড়ি করলে বকাবকি করা উচিত নয়। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে তারা বাইরে আড্ডা দিতে চায়। খেয়াল রাখতে হবে, কোন ধরনের ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশছে। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে সন্তানকে সময় দিলে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয় না। এতে না হয় একটু কষ্টই হলো।’
সানবীমস স্কুলের ক্লাস সেভেন পড়ুয়া অপরাজিতা হেসে মায়ের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বলে, ‘মাঝেমধ্যে মা ধমক দেন। তখন খুব রাগ হয়। পরে অবশ্য বুঝিয়ে বলেন। আদর করেন। মায়ের সঙ্গে সব শেয়ার করি। কিছু না বললেও কী চাইছি সেটি মা বুঝে ফেলেন। আমার অনেক বন্ধুর মায়েরা ওদের বোঝেন না। এটি খুব কষ্টের। মার সঙ্গে সময় কাটাতে খুবই ভালো লাগে। তাই তো মা-ই হলো সবচেয়ে ভালো বন্ধু।’
মা-মেয়ের বন্ধুত্ব এক দিনে তৈরি হবে না। বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে এর শুরু করতে হবে। তখন এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এ সম্পর্ক হবে বিশ্বাস, ভালোবাসা আর নির্ভরতার। এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আরও বলেন, এ বয়সে সন্তানেরা আড়াল করতে চায় সবকিছু। নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়। সেখানে অন্যের প্রবেশাধিকার তারা পছন্দ করে না। যে কারণে এই বন্ধুত্ব তৈরিতে মাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে, সেও সাড়া দেবে, খোলাখুলি কথা বলবে। তবে সন্তানের সবকিছু শুনতে যাওয়াটাও ঠিক নয়। এতে সে বিরক্ত হতে পারে। হিতে বিপরীত হয়। সন্তানের এ পরিবর্তনের সঙ্গে মাকে খাপ খাওয়াতে হবে। মেয়ের ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তবেই না সে মাকে শ্রদ্ধা করবে। যেকোনো সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে গল্পের ছলে আগেই জানাতে হবে। এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ সময় তার মনেও পরিবর্তন আসে। ভালো লাগা জন্মায়। সে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই তার মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে, যাতে কোনো কিছু করার আগে পরিবারের কথা ভাবে। এমনকি তার পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজসজ্জা নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। তবে অতি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন নেই। মেয়েকে নিজের মতো করে বড় করতে চান মা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আলাদা দুটো মানুষ। আলাদা সত্তা। মেয়েকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখান। মা তার ভালো চাইছে, এটি মেয়েকেও বুঝতে হবে। অনেক বন্ধুর ভিড়ে মা-ই হতে পারেন প্রকৃত বন্ধু। এমন বন্ধু কি সহজে পাওয়া যায়? এমন বন্ধুত্ব জীবনকে আমূল বদলে দেয়, যা মা-মেয়ে দুজনকেই বুঝতে হবে।
তৌহিদা শিরোপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৪, ২০১০
Leave a Reply