ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ২৮। সাড়ে তিন বছর আগে বিয়ে করেছি। বিয়ে হয় মা-বাবার পছন্দে। বিয়েতে আমার মত ছিল না। অনেকটা জোর করেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা হয়। প্রথম থেকেই আমি তাকে মেনে নিতে পারছিলাম না। ও যথেষ্ট ভালো মেয়ে। চেহারা ততটা আকর্ষণীয় নয়। আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আমার মন থেকে তার প্রতি ভালোবাসা কখনোই আসেনি। তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারছি না। আমার মনে হয়, পছন্দ করা মেয়েকে যদি বিয়ে করতাম, তাহলে তাকে অনেক ভালোবাসতাম, অনেক সুখী হতাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তোমার অত্যন্ত সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা চিঠির জন্য ধন্যবাদ। তিন বছর আগে তুমি বিয়ে করেছ, কাজেই ধরে নিচ্ছিত, তোমার বয়স তখন ২৫ ছিল। এই বয়সের একটি মানুষকে অবশ্যই তাঁর সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতে হবে। তুমি যদি বলো, ‘মা-বাবার ইচ্ছায় হয়েছে’, ‘তোমার মতের বিরুদ্ধে হয়েছে’, তাহলেও কিন্তু তুমি দায়িত্ব এড়াতে পারো না। কারণ, এই বয়সে থাকা একটি মানুষকে জোর করে বিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া তুমি কি বিয়ের আগে মেয়েটিকে একেবারেই দেখোনি বা কথাও বলোনি? যদি তার ছবিও না দেখে থাকো, তাহলে তো বলতে হয় সেখানেও তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করোনি। যে মানুষটি তোমার জীবনসঙ্গী হতে যাচ্ছে, তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না নিয়ে তুমি যদি এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো, তাহলে তো বলতে হয়, তুমি একটি বড় ধরনের ভুল করেছ। যদি বিয়ের আগে ওকে দেখার সুযোগ হয়ে থাকে, তাহলে ওর চেহারা আকর্ষণীয় নয়, এটি বলার আর সুযোগ থাকে না। কোনো দোষ না করে মেয়েটি একটি ভালোবাসাহীন বিবাহিত জীবন যাপন করছে এবং প্রতি মুহূর্তেই কষ্ট পাচ্ছে। তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো, ওকে বিনা দোষে শাস্তি দেওয়ার অধিকার তুমি রাখো কি না। তুমি নিজের কাঁধের দায়িত্ব মা-বাবার ওপর চাপিয়ে দিয়ে সারাক্ষণ ভাবছ ‘ও তোমার পছন্দ করা মেয়ে নয়।’ এই মনোভাব নিয়ে চলতে থাকলে তোমাদের দুজনেরই দুঃখের কোনো শেষ থাকবে না। এবার জীবনের দায় নিজের কাঁধে নাও এবং যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত নাও। যদি মনে হয়, বিয়েটি যেহেতু হয়ে গেছে, তুমি এটি ভাঙতে চাও না, তাহলে ‘অন্য কাউকে বিয়ে করলে সুখী হতাম’—এই ভাবনা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে। আর যদি মনে হয়, শুধু শুধু এ সম্পর্ক টেনে নেবে না, তাহলে মেয়েটিকে অত্যন্ত সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তোমার অপারগতার কথা জানাও। এ কথা শোনার পরও যদি সে এই ভালোবাসাবিবর্জিত জীবন চালাতে চায়, তাহলে তুমি কী করবে, সেটা খুব ভালো করে ভেবে ওকে বলো। তোমাকে মনে রাখতে হবে, একটি বিয়ের বন্ধন ছিন্ন করলেও কষ্ট রয়েছে আবার জোর করে কোনো রকমে সেটি ধরে রাখাও কষ্টের। কাজেই যেকোনো একটি রাস্তা বেছে নেওয়া প্রয়োজন। আর এ কথাও মনে রেখো, কারও চেহারা আকষর্ণীয় হলেও অন্য কোনো মেয়ে তোমার স্ত্রীর মতো একজন ভালো মানুষ হবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সমস্যা: আমার স্বামী আমার প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি ও আন্তরিকতা দেখায় না। পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে যে রকম আচরণ-কর্তব্য করে, আমাদের সঙ্গেও সে রকম। বাড়তি কোনো কিছুই পাই না। আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসও তার কাছে চেয়ে সহজে পাওয়া যায় না। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। ছোট ছেলের জন্মের পর এইচএসসি পরীক্ষা দিই। ওদের নিয়ে আমার সময় চলে যায়। স্বামীর অবহেলা-অবজ্ঞার মধ্য দিয়েই দুই ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে নিই। এখন আর পারছি না। আপা, মানসিক দিক দিয়ে আমি খুব ভেঙে পড়েছি। দুই ছেলে তাদের ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। বর্তমানে স্বামীর অবহেলা খুব বেশি কষ্ট দেয়। তার বয়স ৪৭, আমার বয়স ৩৭। বিবাহিত জীবনে তার কাছ থেকে কোনো উপহার পাইনি বা শখ করে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এখন তার ওপর আমি বিরক্ত। তার কথাও ভালো লাগে না। আমার জীবনের শেষ সময়ে এসে আমি কোনো কিছু হারাতে চাই না।
তাজ্বরী, ঢাকা
পরামর্শ: আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এটি ঘটেই চলেছে। তোমার যখন বিয়ে হয়েছে, তুমি শিশু ছিলে। মেয়েসন্তানটি পৃথিবীতে এনে তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে সবার মন জুগিয়ে চলার জন্য পাঠানোটা খুব বড় অন্যায়। যে বয়সে স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটানো এবং শিক্ষকদের সাহচর্যে জ্ঞান অর্জন করার কথা, সেই অপরিণত বয়সে তুমি সংসারের বোঝা টেনেছ। আর যদি সেই পরিবেশটা ভালোবাসাহীন, নিরানন্দ হয়, তাহলে তো জীবনটা টেনে নেওয়া বেশ কঠিন। তবু তো তুমি দুই সন্তানের মা হওয়ার পর এইচএসসি পাস করেছ। তোমার বয়স এখনো খুব বেশি নয়, সম্ভব হলে আরও পড়ালেখা করতে পারো। তোমার দুই ছেলে যে ভালোভাবে লেখাপড়া করেছে, সেখানে তো তোমার অবদানই সবচেয়ে বেশি ছিল বলে মনে হচ্ছে। এটি কিন্তু তোমার জীবনের অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক। ওরা এখন নিজেদের ভবিষ্যত্ গড়তে ব্যস্ত থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? তুমিও নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে ওদের প্রতিষ্ঠিত দেখলে। যেহেতু ওরা এখন নিজেদের দায়িত্ব নিতে শুরু করেছে, তুমি নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করো। বাড়ির কাছে স্কুল থাকলে তুমি সেখানে বিনা পারিশ্রমিকে কিছু পড়াতে পারো। এতে ছোট শিশুদের তুমি যেমন নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে আলোকিত করতে পারবে, তেমনি ওদের প্রাণবন্ত সাহচর্যেও তোমার মধ্যে সুন্দর অনুভূতি সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া কোনো হাতের কাজ করে বা আশপাশের দুঃখী মানুষের সেবা করেও কিন্তু খুব তৃপ্তি পাওয়া যায়। সামান্য কিছু অর্থ উপার্জনের কোনো পথ যদি থাকে, তাহলে খুব ভালো হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মেয়েদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়। যে স্বামী এত বছর তোমার প্রতি এবং সন্তানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না, তাঁর কাছে কি সেটি সারাক্ষণ প্রত্যাশা করে কোনো লাভ হবে? বরং এই প্রত্যাশা প্রতিদিন তোমার দুঃখ আর হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্য কেউ যত্ন বা আদর না করলেও তুমি অন্তত নিজেকে আর একটুও অবহেলা করবে না, কেমন? অনেক শুভকামনা রইল তোমার জন্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০১, ২০১০
Leave a Reply