সবার সঙ্গে মিলে চলার মানসিকতা রাখতে হবে কাজের জায়গায়। কৃতজ্ঞতা: গ্রে ঢাকা সাদিয়া আহমেদ পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। কাজের পরিবেশটা ছিল চমৎকার। পড়াশোনার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করার জন্য সম্প্রতি সাদিয়া যোগ দিয়েছেন একটি বহুজাতিক সংস্থায়। নতুন চাকরির জায়গায় সবার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলা, মাপা হাসি, কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রমাণ রাখা এবং সর্বোপরি সময়ের বাইরে আর এক সেকেন্ডও অফিসে নয়—এ বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে একটু একটু করে যেন সাদিয়া নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। এখন তিনি বুঝে গেছেন, এসব করপোরেট অফিসে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে যে অলিখিত বিধি-বিধান আছে, সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে পারলেই সব ঠিকঠাক।
বাংলাদেশে এখন বহুল আলোচিত শব্দ হলো ‘করপোরেট’। করপোরেট পরিবেশ, করপোরেট অভ্যাস, করপোরেট পোশাক, করপোরেট খাবার—এ রকম আরও হাজারটা বিষয় রয়েছে এ শব্দটিকে ঘিরে। তবে অনেক শব্দের মধ্যে গুরুত্বপর্ণ শব্দটি হলো করপোরেট আচরণ। বাংলাদেশে বিশ্বায়নের যুগে অনেক বহুজাতিক সংস্থাই তাদের শাখা খুলে বসেছে। এসব অফিসে কাজের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ, তেমনি রয়েছে তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন। আর এ ধরনের নিয়মকানুন অনেক বেশি পেশাদার বলেই এখন যেকোনো বেসরকারি এমনকি কখনো কখনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব নিয়মকানুন মেনে চলছে। এই নিয়মকানুনের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে করপোরেট আচরণ।
একটি বহুজাতিক দাতা সংস্থায় কাজ করেন রুদমিলা চৌধুরী। তাঁর মতে, করপোরেট অফিসে আচরণ হওয়া চাই পুরোপুরি করপোরেট-স্টাইলে। যার অর্থ পেশাদারি, কৌশলী ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখে কাজ করা। রুদমিলা মনে করেন, করপোরেট আচরণের জন্য যে যে বৈশিষ্ট্য থাকা চাই তা হলো, সৌজন্য, বিনয়, পেশাদারি, নিয়মনিষ্ঠা ও আনন্দের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা।
প্রথমেই যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সৌজন্য। সৌজন্য বজায় রেখে কাজ করতে পারলে কাজের ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সাফল্য আসবেই। সহকর্মীদের কাজের খাতিরে ধন্যবাদ জানানো বা কিছু চাইতে গেলে ‘দয়া করে’, ‘অনুগ্রহ করে’ শব্দগুলো ব্যবহার করলে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়বে, কমবে না।
কাজের ক্ষেত্রে বিনয়ী হতে হবে। আচরণে বিনয় থাকলে এ করপোরেট জগতে যে কেউ এগিয়ে যাবে অনেক দূর। বিনয়ী হতে হবে অন্যের প্রতি। সেই সঙ্গে থাকতে হবে সহকর্মীর প্রতি সম্মানবোধ।
করপোরেট পরিবেশে পেশাদার হতে হবে সবকিছুতেই। কাজের ক্ষেত্রে পেশাদারির কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না। সেই সঙ্গে আচার-আচরণ তো রয়েছেই। এমনকি পোশাকেও থাকতে হবে পেশাদারির ছোঁয়া। এমন কোনো পোশাক পরা যাবে না, যা অফিসের নিয়মের বাইরে যায়। আবার খুব বেশি ক্যাজুয়েল পোশাক তো পরাই যাবে না। পোশাকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম থাকলে তা মেনে চলতে হবে।
নিয়মানুবর্তী হতে হবে সব সময়। কাজগুলো যেমন নিয়ম মেনে করতে হবে, তেমনি সময়মতো শেষ করা চাই। একইভাবে সময় মেনে মিটিংয়ে যেমন উপস্থিত থাকতে হবে, তেমনি অফিসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকা চাই।
কাজের মধ্যে খুঁজে নিতে হবে আনন্দ। আনন্দ নিয়ে কাজ করলে সেই কাজ যেমন ভালো হবে, তেমনি আন্তরিকতাও তৈরি হবে। অফিসে যেহেতু আমাদের দিনের অনেকটা সময় পার করতে হয়, তাই আমাদের উচিত কাজের পরিবেশকে অনেক বেশি আনন্দময় করে তোলা।
কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে আচরণ
একে-অপরকে সম্মান করুন। কারও সামনে সহকর্মীর সমালোচনা করবেন না।
কখনোই সহকর্মীকে এড়িয়ে চলবেন না। দেখা হলে কুশল বিনিময় করুন।
যাঁরা কাজে নতুন যোগ দিয়েছেন, তাঁরা সবার সঙ্গে কথা বলুন, পরিচিত হয়ে উঠুন। যাঁরা পুরোনো, তাঁরা নতুন সহকর্মীর নামটি প্রথমে জেনে নিন। কোনো অবস্থাতেই তাঁদের বিচ্ছিন্ন রাখবেন না।
সহকর্মীদের সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলা যাবে না। সহকর্মীকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে গেলে তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করুন।
সমালোচনা না করে সহকর্মীকে কাজের গঠনমূলক পরামর্শ দিন।
দলের সব সদস্যের সঙ্গে একই আচরণ করুন। একেকজনের সঙ্গে একেক ধরনের আচরণ করবেন না। উন্নতি ও বিকাশের জন্য অধস্তনকে সাহায্য করুন এবং তাঁদের কাজের প্রশংসা করুন।
সহকর্মীর কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সময় নিন এবং তা আস্থার সঙ্গে সম্পন্ন করুন।
ভিন্ন পেশা থেকে এসে থাকলে নিজেকে আলাদা করে ফেলবেন না। সবার সঙ্গে মিশে অফিসের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিন।
সহকর্মীদের মতের সঙ্গে একমত হতে না পারলেও তাঁদের মতামতকে অশ্রদ্ধা করবেন না।
কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় তত্ক্ষণাত্ প্রতিবাদ না করে গঠনমূলক মন্তব্য করুন ব্যক্তিগতভাবে।
প্রকাশ্যে সহকর্মীদের তিরস্কার করা উচিত হবে না।
পদমর্যাদা নির্বিশেষে পরামর্শ মন দিয়ে শুনুন।
অফিসের বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশ নিন এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করুন।
শিষ্টাচার এবং শালিনতা প্রদর্শন করুন।
প্রয়োজনীয় তথ্য নিজের কাছে না রেখে প্রয়োজন বুঝে অন্যদেরও জানান।
অফিসের কোনো অনুষ্ঠানে আপনি চেনেন না বা কম পরিচয় আছে, এমন কারও পাশে বসুন।
একটিমাত্র মন্তব্য বা আচরণের ভিত্তিতে কারও সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করবেন না।
যাঁরা নতুন কোনো করপোরেট অফিসে কাজে ঢুকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন না, কী করবেন আর কী করবেন না। উল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে সুদৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী ও বিনয়ী হয়ে উঠুন। দেখবেন করপোরেট অফিসের সিঁড়ি বেয়ে কেবল ওপরেই উঠছেন।
ফারহানা আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৭, ২০১০
Leave a Reply