ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ২০। বিবাহিত। একটি বাচ্চা আছে। আমার মা আমার স্ত্রীর সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেন। আমার স্ত্রীর বয়স ১৪। সে কোনো প্রতিবাদ করে না। আর আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি বলে আমিও প্রতিবাদ করি না। আমার স্ত্রী কাজকর্মে একটু দেরি করলে মা তার গায়ে পর্যন্ত হাত তোলেন, আমাদের আলাদা হতে বলেন। আমার মা-ই আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে করান। আমি গার্মেন্টসে চাকরি করতাম। সে সময় আমি পরকীয়ায় জড়িয়ে যাই। এ বিষয়টি আমার মা জেনে যান। এমতাবস্থায় আমার মা আমাকে গ্রামে এনে বিয়ে করান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: আমি বুঝতে পারছি তুমি কতটা অসহায় বোধ করে এই চিঠিটি লিখেছ। তবে তোমাদের কারোরই কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স হয়নি। তোমার স্ত্রী এখনো একজন শিশু। এ ক্ষেত্রে তোমার মায়ের প্রথম অন্যায় হয়েছে তোমাকে ২০ বছর বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন করা। তোমার স্ত্রীর অভিভাবকদেরও এই অপরাধের ভাগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তুমি এবং যে কাজী বিয়ে পড়িয়েছেন তিনিও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। এ দেশের অনেক পরিবারেই এ ধরনের অন্যায় ঘটছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোও সন্তানদের ঠিকমতো ভরণপোষণ করতে না পারার কারণে বাল্যবিবাহ অব্যাহত রেখেছে। তোমার স্ত্রী কি এমনই একটি পরিবার থেকে এসেছে কি না জানি না, তবে তার পরিবার সচ্ছল হলে হয়ত বা তাদের শিশু সন্তানটিকে ভুল করে বিয়ে দিয়ে থাকলেও এই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়াত। তোমার মা কি ওর অভিভাবকের কাছে যৌতুক আশা করেছিলেন? সেটি না পাওয়ার কারণেই কি তিনি তাঁর ছেলের বউকে এভাবে নির্যাতন করছেন? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তো আরও একটি অন্যায় যুক্ত হবে। তুমি মাকে ভালোবাস বলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না, এটা কি ঠিক আছে? তোমার চোখের সামনে যেহেতু এই নির্যাতন ঘটছে, তুমি তোমার নৈতিক মূল্যবোধকে মাথায় রেখে মাকে বুঝিয়ে বলো যে এতে করে তিনি একটি বড় ধরনের অন্যায় করছেন। তাহলে নিজের বিবেকের কাছে তুমি সত্ থাকতে পারবে। মা ভেবেছিলেন, তোমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু তাতে যে সমস্যা আরও অনেক গুণ বেড়েছে এবং বেশ কয়েকটি মানুষ এতে ভুক্তভোগী হয়েছে, এটা তাঁকে অবশ্যই বলতে হবে। তোমার বয়ঃসন্ধিতে থাকা স্ত্রী একটি শিশুসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তার ভবিষ্যিট কেমন হবে সেটিও কিন্তু ভাবতে হবে তোমাকেই। কারণ তোমার স্ত্রী তো সারাক্ষণ তার নির্যাতনকারী শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলতেই হিমশিম খাচ্ছে। একটি সন্তানকে সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে পরিবেশ দরকার সেটিও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তোমার মায়ের অসুস্থ আচরণের কারণে। এ ধরনের নির্যাতন দীর্ঘদিন মুখ বুজে সহ্য করতে থাকলে তোমার স্ত্রী একদিন মানসিক রোগীতে পরিণত হতে পারে। আমার অনেক অনুরোধ থাকবে তুমি তোমার স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্বটুকু পুরোপুরি নিয়ে নাও এবং স্ত্রীকে উপযুক্ত মর্যাদা দাও। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁকে তাঁর ভুল ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব এই বিশ্বাসটি মাথায় রাখো।
সমস্যা: আমার সমস্যা, আমি একদম ইয়ার্কি সহ্য করতে পারি না। আমি সব রকম আচার-আচরণ ‘সিরিয়াস’ হিসেবে গ্রহণ করি। আমি নিজেকে অন্যরকম মনে করি। আমার মনে হয় আমার ভেতরে কোনো বড় ধরনের প্রতিভা আছে। আমি হয়তো কোনো বিশেষ কাজ সম্পাদনের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছি। আমি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায়ই গবেষণা করে থাকি। এ ধরনের আচরণ কি সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
সিরাজগঞ্জ।
পরামর্শ: কেউ আমাদের কোনো বিষয় নিয়ে বেশি মাত্রায় ঠাট্টা করলে সহ্য করা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত রাগ বা দুঃখ কাজ করলে আমরা নিজেরাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি না। তুমি কি মানুষের এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে খুব বেশি সময় ধরে চিন্তা করতে থাক? তাই যদি হয় তাহলে নিজেকে সাময়িকভাবে অন্য কোনো ভাবনা বা কাজে নিয়োজিত করার চেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজস্ব মনোভাব প্রকাশ করার এবং তার পরও আমরা শান্তি রক্ষা করে সহাবস্থান করতে সক্ষম। এই বিশ্বাসটুকু দৃঢ়ভাবে মনে স্থান দিতে পারলে অন্যের সঙ্গে যেমন বিরোধ এড়িয়ে চলা সম্ভব ঠিক তেমনি নিজের মানসিক শান্তিও বজায় রেখে চলা যায়। তবে তুমি লিখেছ, তোমার মনের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে, নিজেকে বিশেষ কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ বলে মনে হচ্ছে—এই ব্যাপারগুলো বেশি বাড়াবাড়ি রকমের হতে থাকলে কোনো মনোরোগ চিকিৎসক অথবা কোনো সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনে মনে অতিরিক্ত গবেষণা করতে থাকলেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা বাধাগ্রস্ত হয়। তুমি বর্তমানে কী করছ তা জানাওনি। তোমাকে বুঝতে হবে এ ধরনের মানসিক অবস্থা তোমার জীবনের লক্ষ্যগুলো অর্জনে কতটুকু বাধা দিচ্ছে । তবে এখনো যে পুরোপুরি অলীক কল্পনার জগতে সারাক্ষণ বিচরণ করছ না সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ, তুমি তোমার সমস্যাগুলো নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। পরিবারে বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যদি কোনো জ্ঞানী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি থাকেন তাঁর সঙ্গে তুমি বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করো। সম্ভব হলে এবং খুব বেশি অসুবিধা চলতে থাকলে ঢাকায় এসে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে (১৯০/১, ওয়্যারলেস রেলগেট, বড় মগবাজার, ঢাকা, ফোন ৯৩৫১১৯০-৯১) অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাইকোথেরাপি নাও।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০১০
Leave a Reply