বৈশাখের প্রথম দিনে নববর্ষকে বরণ করে নিতে নানা আয়োজন করে বাঙালিরা। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে শোভাযাত্রা ও বিভিন্ন আয়োজন থাকে। এসব আয়োজনে মুখোশের ব্যবহার বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তোলে।
বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন—মুখোশ ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম মুখোশ ব্যবহার করা হয়। মুখোশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন জিনিসের প্রতিকৃতি।
বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বাহারি ডিজাইন ও রঙের মুখোশ দেখা যায়। বৈশাখের বাংলা নববর্ষবরণের বাহারি ডিজাইন ও রঙের মুখোশ তৈরি করতে পারেন আপনিও। বাংলা বর্ষবরণের মুখোশ তৈরি করার জন্য কর্মশালার আয়োজন করেছেন শিল্পী তরুণ ঘোষ। ঢাকার লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে ৩৫ জনকে নিয়ে মুখোশ তৈরির কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে।
মুখোশে হাটে
শেষ বিকেলের সূর্যের আলোয় স্কুলের মাঠে ঢুকতেই মনে হলো মুখোশের হাটে ঢুকেছি। অনেকে বাহারি রঙের বিভিন্ন আকারের মুখোশ তৈরি করছেন। কেউবা মুুখোশে রং করছেন, কেউ রঙের মিশ্রণ করছেন, অনেকেই ঘষে নিচ্ছেন মুখোশের কাগজের আস্তরণটি, কেউ শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন ভালোভাবে শেষ হয়েছে কি না। আর মাঝেমধ্যে একেকজন সমস্যা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন একজনের কাছে। তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, কোথায় কোন রং করা হবে, কীভাবে আরেকটু সুন্দর করা যাবে মুখোশটি। বুঝিয়ে দেওয়া মানুষটিই শিল্পী তরুণ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখে মুখোশের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮৮-৮৯ সাল থেকে। এর আগে নববর্ষ পালন করা হতো কিন্তু মুখোশের ব্যবহার হতো না। নিজের আগ্রহ থেকেই মুখোশ বানানো শুরু করি।’ তিনি বলেন, ‘নিজের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই মুখোশ বানানোর ওপর। প্রথম দিকে ঐতিহ্যবাহী কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন মুখোশ বানানোর সাহস দেখাই। প্রথম দিকে অন্য রকম একটি আগ্রহ কাজ করত নিজের মধ্যে। এমন অনেক দিন গেছে, সারা রাত জেগে মুখোশ তৈরি করেছি। প্রথম দিকের কাজ করার অভিজ্ঞতা এখনকার থেকে অনেক আলাদা।’ ‘বর্তমানে বাংলাদেশে মুখোশের চাহিদা বেড়েছে। সারা বিশ্ব লোকজ ধারা থেকে আধুনিক ধারায় প্রবেশ করছে, মুখোশও এর ব্যতিক্রম নয়।’ জানান তরুণ ঘোষ। এখন অনেক রকমের কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছে মুখোশ তৈরি করার জন্য।
নিজেই বানান মুখোশ
বৈশাখ বা যেকোনো উৎসবে ইচ্ছা করলেই তৈরি করতে পারবেন পছন্দের মুখোশটি। কীভাবে তৈরি করবেন তা জানালেন তরুণ ঘোষ। মুখোশ তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মাটি। প্রথমে মাটির আবরণ দিয়ে মুখোশের প্রাথমিক একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। মাটির আবরণের মাধ্যমে হাস্যরস, করুণ, ভয়ানক বা কোনো পশুপাখির মুখটা আগে তৈরি করতে হবে। এক কথায় বলা যায়, নিজের কল্পনাটি মাটির মাধ্যমে ফুটিয়েতুলতে হবে। তিনি বলেন, মাটি একটি নরম মাধ্যম। এটি সব রকম আকার দেওয়া যায়। নির্দিষ্ট পছন্দের আকার দিয়ে নরম মাটি ছায়ায় শুকাতে হবে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, খুব রোদ আছে এমন স্থানে শুকানো যাবে না। খুব বেশি রোদে শুকালে মাটির মুখোশটি ফাটল ধরতে পারে। মুখোশটি শুকিয়ে একটু শক্ত হলে তুলে আনতে হবে।
এরপর শুকানো মুখোশটির ওপর গ্রিজ লাগিয়ে পিচ্ছিল করতে হবে। একটু বেশি করে গ্রিজ লাগাতে হবে, যাতে মাটির কোনো উঁচু-নিচু ভাব না থাকে। গ্রিজ লাগিয়ে মাটি মসৃণ করে ফেলবেন। গ্রিজ ব্যবহার করার পর মাটি মসৃণ হলে সঙ্গে সঙ্গে একদম পাতলা পলিথিন হালকা করে লাগিয়ে দিন মুখোশের ওপর। এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, মাটির মুখোশটি উঁচু-নিচু সব স্থানে যেন সমানভাবে লাগে। এরপর ময়দা নিয়ে একটু আঠালো লেই বানাতে হবে। আঠালো ময়দার মধ্যে একটু তুঁত ব্যবহার করতে হবে। তুঁত মেশানোর সময় লক্ষ রাখতে হবে এটি যেন কোনো খাবারের পাত্রে না রাখা হয়। তুঁত দেওয়ার পর আঠা বিষাক্ত হয়ে যাবে। আঠা হাত দিয়ে ধরার পর কোনো কিছু খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
এবার খবরের কাগজের ছোট ছোট টুকরো করে এক দিক থেকে মাটির মুখোশের ওপর লাগাতে হবে। এভাবে একবার সম্পূর্ণ লাগানো হলে আবার আঠার প্রলেপ দিয়ে আবার কাগজ লাগাতে হবে। এভাবে মোট পাঁচ-ছয়বার লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে একবার খবরের কাগজ, একবার বাঁশ কাগজ (মইশা কাগজ) ব্যবহার করলে ভালো হয়। আঠার সঙ্গে বাঁশ কাগজ (মইশা কাগজ) লাগালে কাগজটি অনেক ভালো লাগে। এর ফলে মুখোশটি অনেক বেশি শক্ত হয় এবং অনেক দিন টিকে থাকে। লাগানো কাগজগুলো যেন মুখোশটির চেয়ে একটু বড় হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাঁচ-ছয়বার লাগানোর পর কাগজসহ মাটির মুখোশটি রোদে শুকাতে দিতে হবে। এখানে ছায়ায় শুকানোর দরকার নেই। রোদে শুকালে বেশি ভালো হয়। যখন কাগজ লাগানো মুখোশটি শুকিয়ে যাবে, তখন রোদ থেকে তুলে আনতে হবে।
শুকানো মুখোশটি মাটির অংশ থেকে একটু আলগা করে দিতে হবে। এরপর যখন ভালোভাবে শক্ত হবে, তখন কাগজের মুখোশটি মাটির মুখোশ থেকে উঠিয়ে আনতে হবে। এরপর মুখোশটি উল্টো করে আর কিছু সময় শুকাতে হবে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, মুখোশটি যেন পুরো উল্টো না করেন। সম্পূর্ণ উল্টে করলে মুখোশের বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কাগজের মুখোশ ভালোভাবে শুকানোর পর রং করতে হবে। সাদা অক্সাইড পাউডারের সঙ্গে প্লাস্টিক পাউডার মিশিয়ে রং যখন ঘন মুখোশে লাগানোর মতো হবে, তখন সাদা রং এক থেকে তিনবার লাগালে হবে। লক্ষ রাখুন, মুখোশটি যেন ভালো করে সাদা হয়। সাদা হওয়ার ওপর নির্ভর করে অন্য রংগুলো কী রকম হবে।
এরপর সাদা রং করা কাগজের মুখোশটি কিছু সময় শুকাতে দিন। শুকানোর পর পছন্দমতো রং দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে রাঙিয়ে তুলুন মুখোশটি। তরুণ ঘোষ জানান, রং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রংধনুর সাত রং ব্যবহার করলে ভালো হয়। রং করার সময় সব সময় মৌলিক রংগুলো ব্যবহার করার দিকে বেশি জোর দিন। এ ছাড়া আমাদের লোকজ ধারা আছে এমন বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রেখে মুখোশটি রং করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তরুণ ঘোষ বলেন, মুখোশে বানানো এবং রং দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি দিক লক্ষ রাখবেন মুখোশের চোখ, কান, নাকগুলো যেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় হয় এবং ওই অংশগুলো রং করার সময় উজ্জ্বল রং ব্যবহার করুন।
তরুণদের আগ্রহ বেশি
লালমাটিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী প্রিঙ্কায়া শখের বশে মুখোশ বানাতে এসেছে। ‘পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রায় যাব, তাই মুখোশ বানানো শিখতে এসেছি।’ প্রিঙ্কায়া জানায়, এটিই তাঁর প্রথম মুখোশ বানানো।
একটি স্কুলের চারুকলা শিক্ষক সুপর্ণা ঘোষাল বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছায় মুখোশ বানানো শিখতে এসেছি। আমি শিখে স্কুলে শিক্ষার্থীদের মুখোশ বানানো শেখাব।’ শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার বিভাগের ছাত্রী ঊর্মি বলেন, ‘নিজের পেশার উপকারের জন্য মুখোশ বানানো শিখতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মুখোশের ওপর আরও বেশি কর্মশালা ও বিভিন্ন উৎসব আয়োজন করা উচিত। ১২ দিনের এই কর্মশালায় দুটি গ্রুপে মোট ৩৫ জন অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের তৈরি করা মুখোশ দিয়ে পয়লা বৈশাখে লালমাটিয়ায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হবে।’
তারিকুর রহমান খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৬, ২০১০
Leave a Reply