জীবনে চলতে-ফিরতে যেসব আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, পাঠকের উকিল বিভাগে ১৫ দিন পরপর তারই সমাধান পাওয়া যাবে।পাঠকের উকিল বিভাগে আইনি সমস্যার সমাধান দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট নাহিদ মাহতাব। স্পষ্ট করে নিজের সমস্যাটি লিখে পাঠান। প্রয়োজনীয় কাগজের অনুলিপি দিন।
খামের ওপর লিখুন : পাঠকের উকিল, নকশা, দৈনিক প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুলইসলাম এভিনিউ কারওয়ান বাজার, ঢাকা
পরিবারের প্রধান মা-বাবা চার ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে মারা যান। পরবর্তী সময়ে বড় ছেলেও মারা যায়। মায়ের নামে ছয় কাঠা জমির ওপর একটি মার্কেট আছে। মা মারা যাওয়ার আগে ওই মার্কেট দুই ছেলের নামে লিখে দেন এওয়াজ বদল দলিলে। মায়ের নামে ছেলেরা যে এওয়াজ বদলে জমি দেয়, সেই জমি মা ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষকের নামে আমমোক্তার করে দেন তাঁর অজান্তে। এই দলিল সম্পর্কে ওই শিক্ষক কিছুই জানতেন না এবং তিনি জমিটি দান, বিক্রি বা ভোগদখল কিছুই করেননি। ওই জমি ছেলেমেয়েদের দখলে আছে। মা মারা যাওয়ার পর আমমোক্তারনামা দলিল আইনত বাতিল হয়ে গেছে।
ছোট মেয়ে তাদের পারিবারিক কলহের কারণে যে দুই ভাই মায়ের সঙ্গে এওয়াজ বদল দলিল করেছেন, সেই দুই ভাই এবং ওই গৃহশিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ মামলায় শিক্ষকের কী করণীয়?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
যেহেতু আমমোক্তারনামাটি মায়ের মৃত্যুর পরপরই বাতিল হয়ে গেছে, সেহেতু ওই জমিতে গৃহশিক্ষকের আইনগত কোনো অধিকার নেই। সুতরাং এ ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষকের করণীয় হচ্ছে, আদালতে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা।
আমি এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। আমার বয়স ১৭ বছর। একটি ছেলেকে খুব ভালো বাসতাম। কিন্তু তা সে বিশ্বাস করতে চাইত না। সে বলত, তোমাকে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। সে আমাকে একটা দলিলের মতো কাগজ দেয়। ওই কাগজে আমার ও তার জীবনবৃত্তান্ত লেখা ছিল। আমার বয়স লেখা ছিল ১৯, ওর বয়স ২৬ (ওর প্রকৃত বয়স ৩০)। আরও লেখা ছিল, আমরা পাঁচ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে আসছি। কেউ যদি পরবর্তী সময়ে কিছু বলে, তবে সেটা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। সবশেষে দুজনের সই। তবে সে আমাকে বলেছে, ‘এটা শুধু কাগজ, যা তুমি চাইলেই ফেরত পাবে। তুমি রাজি থাকলে আমাদের সামাজিকভাবে বিয়ে হবে, নতুবা নয়।’
কিন্তু এখন কোনো এক বিশেষ কারণে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। এমনকি তাকে বিয়ে করাও সম্ভব নয়। একদিন ফোন করে তার কাছে ওই কাগজটা চাইলাম, সে তা দিতে অসম্মতি জানাল। বলল, আমি নাকি তার বিবাহিত স্ত্রী। আমার প্রশ্ন, এই কাগজে সই করার মাধ্যমে কি সত্যিই আমাদের বিয়ে হয়েছে? ভবিষ্যতে ওই কাগজ দিয়ে কি সে আমাকে আইনি সমস্যায় ফেলতে পারবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, রংপুর
শিক্ষাগত সার্টিফিকেটে প্রদত্ত জন্মতারিখ অনুযায়ী আপনার বয়স ১৭ বছর হলে আপনি এখনো নাবালিকা। সুতরাং আইনগতভাবে ছেলেটি আপনাকে কোনো সমস্যায় ফেলতে পারবে না। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাগজে সই করার ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক হতে হবে। কারণ, এ ধরনের কাগজ বা দলিল প্রকাশ পেলে সমাজে আপনার সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমার স্বামী আমাকে বিয়ে করেন। তাঁর আগের ঘরে তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছে। বর্তমানে আমাদের দেড় বছর বয়সের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। আমার স্বামী তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমার বিয়ের আগেই তাঁর গার্মেন্টসের ১০০ শেয়ারের মালিক তিনি এবং বাকি ১০০ শেয়ার তাঁর আগের চার ছেলেমেয়ের নামে। স্বামীর অবর্তমানে আমার সন্তান ও আমি কি শেয়ারের অংশ পাব? আমার স্বামী তাঁর সম্পত্তি কোনো সন্তানের নামে লিখে দেননি। আমার কাছে তাঁর সম্পত্তির কোনো কাগজপত্র নেই। তাঁর অবর্তমানে আমার মেয়ে ও আমি কি সম্পত্তি পাব? যদি তাঁর অবর্তমানে আগের ঘরের সন্তানেরা আমাকে অংশ দিতে রাজি না হয়, তাহলে আমার করণীয় কী? স্বামীর অবর্তমানে আমি কি আমার দেনমোহর পাব, নাকি শুধু জীবিত অবস্থায় দেনমোহর পাওয়ার অধিকার থাকে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
আপনার স্বামীর অবর্তমানে আপনি ও আপনার কন্যাসন্তান মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনাদের অংশ পাবেন। এ ক্ষেত্রে কন্যাসন্তানেরা পুত্রসন্তানের অর্ধেক পরিমাণ অংশের অধিকারী। মুসলিম আইনে দেনমোহর এক ধরনের দেনা। এই দেনা জীবিত অথবা মৃত্যুর পরও পরিশোধযোগ্য। আপনার স্বামী জীবিত থাকাকালে আপনার দেনমোহর পরিশোধ না করলে তাঁর অবর্তমানে তাঁর অন্যান্য উত্তরাধিকারী দেনমোহরের অর্থ পরিশোধের পর পৃথকভাবে নিজ নিজ অংশের অধিকারী হবেন।
আমার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে চার বছর প্রেম করার পর ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল তাকে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে গোপনে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করি। বিয়ের দুই দিন পর আমার মাকে আমি সব কথা জানাই। মা আমাদের বিয়েটা সহজে মেনে নিয়েছেন। এরপর আমরা স্বামী-স্ত্রীর হিসেবে চলাফেরা করতে থাকি। আমার দায়দায়িত্ব ও যাবতীয় ভরণপোষণ বহন করে আসছিল সে। এর মধ্যে মা টেলিফোনে একটি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। সে বিদেশে থাকে। তার নাকি অনেক টাকা-পয়সা। আমিও মায়ের কথামতো বিদেশি ওই ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আগের স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে থাকি। আমি মায়ের কথামতো গত বছরের ৫ জুলাই আগের স্বামীকে তালাক দিই। তালাক দেওয়ার সময় আমি তার কাছে কোনো কিছু দাবি করিনি। তালাক যখন দিই, তখন আমি তিন মাস ১০ দিনের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। পেটে বাচ্চা থাকা অবস্থায় তালাক দিলে সেটি কার্যকর হবে? বর্তমানে বিদেশি ওই ছেলের সঙ্গে আমার গোপনে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আমার পেটে বাচ্চা ছিল জানত না সে। আগের স্বামী তার বাচ্চার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। তার কাছে চিকিৎসা প্রতিবেদন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি আছে। আমি গর্ভপাত করিয়েছি। এখন আমি কী করতে পারি? আমি আগের স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে চাই। মা তা করতে দিচ্ছেন না।
সুলতানা
হাটহাজারী, ভবানীপুর
মধুরঘোনা, চট্টগ্রাম
যেহেতু আপনি স্বইচ্ছায় গর্ভপাত ঘটিয়েছেন, সেহেতু আপনার ওপর ফৌজদারি দায় বর্তাবে না। সাধারণত গর্ভকালীন সময় অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত ডিভোর্স কার্যকর হয় না। আপনার দ্বিতীয় বিয়ে গর্ভপাতের কত দিন পর করেছেন, তার উল্লেখ নেই। যদি ইদ্দতকালীন অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করে থাকেন, তাহলে বিয়েটি অনিয়মিত হয়েছে। পুনরায় প্রথম স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে চাইলে, দ্বিতীয় স্বামীকে তালাক দিয়ে ইদ্দতকালীন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর প্রথম স্বামীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে আপনার এ ধরনের আচরণ যথাযথ নয়।
২০০১ সালে বিয়ে করি। এরপর অপরিকল্পিতভাবে একটি সন্তানের জন্ম হয়। বিয়ের পর বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় কেটেছে। তার সঙ্গে শুরু থেকেই আমার মনের মিল ছিল না। তাই সম্পর্কের উন্নতি কখনোই ঘটেনি। অবশেষে ২০০৯ সালে তার অনুমতি ছাড়াই আদালতের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিয়ে করি। ওই সময় প্রথম স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে অবস্থান করছিল। আর আমি কাজের জন্য দূরে ছিলাম। কিন্তু সে আমার দ্বিতীয় বিয়ের খবর পেয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই আমার কাছে চলে আসে। একপর্যায়ে তাকে সন্তানসহ আমার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিই। সে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সেখান থেকে আমার অজান্তে দুই সন্তানকে নিয়ে চলে যায়। কিছুদিন ফোনে যোগাযোগ ছিল এবং টাকা-পয়সাও পাঠিয়েছি। বর্তমানে সে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তার বক্তব্য, সে ওই দুই সন্তান আমাকে দেবে না এবং সে ফিরেও আসবে না। আমি শুধু আমার সন্তানদের ফেরত চাই। কীভাবে আইনের সহায়তায় তা সম্ভব? আমি তালাকনামা পাঠাতে পারব কি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১-এর ৬ ধারা অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের আরবিট্রেশন কাউন্সিলের অনুমতির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিনা অনুমতিতে বিয়ের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেই ব্যক্তির এক বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে। মুসলিম আইনে সন্তানের আইনানুগ অভিভাবক হচ্ছেন বাবা। কিন্তু একজন মা হেফাজতকারী হিসেবে কন্যাসন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত তাকে লালনপালন করার অধিকারী। পুত্রসন্তানের লালনপালনের সময় সাত বছর পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে অভিভাবকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে সন্তানের স্বার্থ ও কল্যাণ। তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার আইনগত বাধা নেই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩০, ২০১০
Leave a Reply