কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্বাধীনচেতা মনোভাব কাজ করে কমবেশি সবার মধ্যেই স্কুলের গণ্ডি শেষ। অয়ন সবে পা দিয়েছে কলেজে। কিন্তু ওর মধ্যে কিসের যেন পরিবর্তন। আগের সেই নম্র ভাবটা যেন আর নেই। কোনো কিছু পছন্দ না হলেই প্রতিবাদ করে। একটু যেন গুটিয়ে থাকে সবার কাছ থেকে। কল্পনায় সাজাতে থাকে নিজের দুনিয়া। সবই ঠিকমতো চলে, তবে বিপত্তি বাধে মা-বাবা তার মতের বিরুদ্ধে কিছু বললে। অয়নের মনে হয়, সে বড় হয়েছে। কলেজে পড়ছে। নিজেই সব বুঝতে পারে। মা-বাবা কেন এত কথা বলেন? রাগ করে একদিন বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। অনেক কষ্টে ওকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন মা-বাবা।
তবে অবন্তীর অবস্থা ভিন্ন। মাঝেমধ্যে ভাবে, নিজের মতো করে চলতে পারছে না। মা-বাবার ইচ্ছানুযায়ী চলতে হয়। ওর মতে, ‘এমন তো নয় যে আমি খুব ছোট। নিজের ভালো-মন্দ বুঝি। কিন্তু সবাই ভাবে আমি কিছুই বুঝি না। সারাক্ষণ জ্ঞান দেয়। ভালো লাগে না।’ বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা, একলা কোথাও যাওয়া, সবকিছুতেই মা-বাবার আপত্তি।
এই বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মা-বাবার বিপত্তিটাও কম নয়। হঠাৎ করেই যেন অচেনা মনে হয় সন্তানদের। কিন্তু এ সময় তাঁদেরই সন্তানের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সন্তানদের বুঝতে হবে তাদের মতো করেই।
বিরোধিতা না করা
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান মনে করেন, নতুন প্রজন্মের ভাবনাই হবে নতুন। রঙিন চোখে তারা দুনিয়া দেখবে, সাহসী হবে পদচারণে, এমনটিই স্বাভাবিক। বিশেষ করে সদ্য কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন আচরণ দেখা যায়। ওরা ভাবে, বেশ তো বড় হয়ে গেছে। ওদের মানসিক পরিবর্তন আসে। নিজের মতো করে থাকতে চায়। কোনো ধরনের বাধা পছন্দ করে না। স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেই বিরক্ত হয়। এ বিষয়গুলো অভিভাবককে বুঝতে হবে। এমন আচরণের পেছনের কারণগুলো খুঁজে দেখতে হবে। ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। অভিভাবককে সন্তানের কথার অযৌক্তিক দিকগুলো দেখিয়ে দিতে হবে। মা-বাবা কেন শাসন করছেন, তাও যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। ওদের কোনো স্বাধীনতা নেই, এমন মনোভাব যেন কখনোই প্রকাশ না পায়। বন্ধুত্ব, গান শোনা, খেলাধুলা—সব দিকেই এ সময় ওরা স্বাধীনতা চায়। এর জন্য বিরোধিতা কিংবা রাগারাগি না করে ওদের পছন্দকে বুঝতে চেষ্টা করুন। ওদের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। ধীরে ধীরে দেখা যাবে, ওরাও আপনার ভালো লাগাকে শ্রদ্ধা করছে। বুঝতে পারবে নিজের ভুলগুলো। সন্তান কিন্তু সব সময়ই ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না। অভিভাবকেরাই অনেক সময় নিজের সিদ্ধান্ত তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। ওদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে জোর করে কাজ করালে ফলাফল আশানুরূপ হয় না, বরং হিতে বিপরীতই হয়। আমরাই সব বুঝি, সন্তানদেরও এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জীবনে আবেগ দিয়ে চলা ভালো। পাশাপাশি তার যৌক্তিকতা থাকতে হবে। সে জন্য এ সময়ে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কী করতে হবে। ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ্য স্থির করে লাভ নেই। এটি ভুল ধারণা। লক্ষ্য স্থির রাখলে জীবনে অস্থিরতা কমে যায়।
যা করা হয়, তা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তাও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, অভিভাবকেরা অভিজ্ঞতা থেকে বলেন। তাঁদের কথা অবহেলা করা উচিত নয়। রাগ করে ঝোঁকের মাথায় অন্যায় করা ঠিক নয়। যে কারণে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবেই নিজের কথাও প্রতিষ্ঠিত হবে। অভিভাবক ভুল কিছু বললে তাঁদেরও নানা উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। স্বপ্ন দেখতে হবে জীবনকে উত্কৃষ্ট করার জন্য। এটি জীবনের অংশ। কিন্তু এই বয়সের প্রেম, ঘোরাঘুরিই জীবনের সবকিছু নয়।
এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদেরই ভূমিকা বেশি। তাঁরা ছেলেমেয়েদের সুন্দর বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারেন। সন্তান যেন অযথা সময় নষ্ট না করে, তা বুঝিয়ে বলুন। কিন্তু অবশ্যই রাগারাগি করে নয়।
স্বাধীনতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়
মা-বাবা বেশির ভাগ সময়ই নিজের সিদ্ধান্তকে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন। নিজেদের অপূর্ণতাকে সন্তানের মধ্য দিয়ে পূরণের চেষ্টা করেন। সন্তানের আগ্রহ কোন বিষয়ে, তার ক্ষমতা কতটুকু তা তাঁরা বুঝতে চান না। এভাবেই মা-বাবার ওপর সন্তানের ক্ষোভ জন্মে। অবাধ্য হয়। তবে এটিও ঠিক, সন্তানও ভুল করতে পারে। কলেজের এ সময়টা এমন, যখন জীবনকে নতুন রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। তখন ভুল করলে বড় মাশুল দিতে হয়। সে কারণে স্বাধীনতার অপব্যবহার করা যাবে না। স্বাধীনতা মানেই কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা নয়, জানান সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উত্তম হালদার।
যেকোনো কিছুই সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করুন। দুই পক্ষের পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন। তাহলে দেখা যাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলেমেয়েরা মা-বাবার চেয়ে প্রিয় অন্য কোনো মানুষের কথাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তিনি হতে পারেন বন্ধু, আত্মীয় কিংবা শিক্ষক। তখন তাঁর মাধ্যমে সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন।
দেখা যাবে, এতে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ৩০, ২০১০
Leave a Reply