ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমার বিয়ে হয়েছে ১২ বছর। নয় বছরের দুটো যমজ ছেলে আছে আমার। তারা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। আমাদের জীবন ভালোই কাটছিল। এক বছর ধরে আমার স্বামী এক নারীর সঙ্গে ফোনে নিয়মিত কথা বলেন। জেনেছি, তাঁর সঙ্গে আমার স্বামীর আগে সম্পর্ক ছিল। মহিলার স্বামী বিদেশে থাকেন। তাঁদের অষ্টম শ্রেণীপড়ুয়া একটি মেয়ে আছে। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমার স্বামী আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এমনকি মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। এখন শুনছি, তিনি নাকি ওই নারীকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবেন। আমি তাঁকে বাধা দিলে তিনি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেই চলেছেন। আমি এখন কী করব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
খুলনা
পরামর্শ: বুঝতে পারছি কতটা অসহায় বোধ করে তুমি তোমার কষ্টের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছ। গত ১২ বছর তোমাদের দাম্পত্য জীবন ভালোই কেটেছে লিখেছো। তবে তোমাদের সম্পর্কে পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধার সংমিশ্রণ কতটুকু ছিল সেটা ভালোভাবে ভেবে দেখতে পারো। স্বামী এখন তাঁর পূর্বপরিচিত মহিলার সঙ্গে সম্পর্কটি তৈরি করেছেন সেটি যদি খুব সিরিয়াস সম্পর্ক হয়ে থাকে, তাহলে স্বামীকে বাধা দিলে বা এ ব্যাপারে তাঁকে কথা বলতে বাধ্য করতে চাইলে সংসারে অশান্তি বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। তোমার স্বামী বিয়ের পবিত্র বন্ধনের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না বা শ্রদ্ধাশীল হচ্ছেন না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে করে তাঁর নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়টিও খুব স্পষ্ট। তবে একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যখন জেনেশুনে নৈতিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেন, তখন তাঁকে অন্য কেউ ফিরিয়ে আনতে পারে না। তোমার অবশ্যই অধিকার রয়েছে, স্বামীর মনোযোগ পাওয়ার এবং তোমাকে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করারও কোনো অধিকার তাঁর নেই। তবে বেশির ভাগ সময় এসব ক্ষেত্রে সুবিচার চাইতে গেলে অনেকেই অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া তোমাদের অশান্তির কারণে সন্তানদের মানসিকতার ওপরও যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, এতে করে ওদের সুনাগরিক হওয়ার অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে। কোনো অন্যায় না করেও ওদের কোমল মন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে ওদের সমস্ত জীবনে।
তুমি যথেষ্ট লেখাপড়া করেছো কি না জানি না, সম্ভব হলে নিজেকে এখনো স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য উদ্যোগ নিতে পারো। কোথাও খণ্ডকালীন কাজ করতে পারো মনটা ব্যস্ত রাখার জন্য। অনেক কষ্ট আর অপমানবোধ হলেও চেষ্টা করবে নিজেকে ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা করতে। যেহেতু তুমি কোনো অন্যায় করোনি, সে কারণে নিজেকে মর্যাদার জায়গাটুকু অবশ্যই দেবে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, শরীরচর্চা, সুস্থ বিনোদন এগুলো করতে পারলে খুব ভালো হয়। আর যদি মনে হয়, তুমি তোমার এবং সন্তানদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করবে, তাহলে ঢাকায় এসে মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’-এর অফিসে গিয়ে আইনজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করতে পারো। ওদের অফিসের ঠিকানা হচ্ছে: ৭/১৭, লালমাটিয়া, ব্লক-বি, ঢাকা, ফোন-৮১২৬১৩৪/৩৭। এ ছাড়া তুমি খুলনায় মানবাধিকার সংস্থা ‘ব্লাস্ট’-এ যোগাযোগ করতে পারো, ঠিকানা: জেলা আইনজীবী সমিতি, পুরোনো ভবন (দ্বিতীয় তলা), কোর্ট রোড, খুলনা, ফোন-০১৭১৫-২৯৯৪১৭ অথবা এই ঠিকানায়ও যোগাযোগ করতে পারো—‘বর্তমান’ ৭, হাজী মুহসীন আলী রোড, খুলনা।
সমস্যা: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। এখনো প্রথম বর্ষ শেষ হয়নি। এরই মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি রাজনীতিতে। প্রথম প্রথম মিছিল, ক্যাম্পাসে দলবেঁধে হাঁটাহাঁটি বেশ উপভোগ করতাম। ক্রমে ক্রমে এ ব্যাপারে বিতৃষ্ণা এসে গেছে। কিন্তু তত দিনে আমি ‘বড় ভাই’দের নজরে পড়ে গেছি। আমার দুই বোন লেখাপড়া করে। একজন হোস্টেলে থাকে। বাবা আমাকে প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা করে পাঠান, যা তাঁর জন্য খুব কষ্টকর। টিউশনি কিংবা পার্টটাইম চাকরি খুঁজি, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারটি আমার অন্যায় বলে মনে হচ্ছে। রাজনীতিতে অনিচ্ছা সত্ত্বে জড়িয়ে যাচ্ছি। না জড়ালে হুমকি। মা-বাবার কষ্টে কথা আর নিজের পরিণতির কথা ভাবলে কান্না আসে। আমি কী করব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরামর্শ: ছাত্রদের অসুস্থ রাজনীতির বিষাক্ত ছোবল তোমাকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তোমাদের মতো অনেক সহজ-সরল এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকা ছাত্রদের প্রলোভন দেখানো এবং প্রতারণার চর্চা চলছে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। এর সুফল ভোগ করছে স্বার্থান্বেষী নেতারা এবং কিছু শিক্ষকও। পরিণতি না বুঝে জড়িয়ে যাওয়া ছাত্রদের মৃত্যু ঘটলেও কারও কিছু এসে যায় না এবং নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিজীবীসমাজ বক্তব্য দিচ্ছেন, এখনো পচন ধরা ছাত্র রাজনীতির সুস্থ রূপ দেওয়া সম্ভব। এত মায়ের বুক খালি হওয়ার পরও তাঁদের মতামত হচ্ছে, এ দেশে ছাত্র রাজনীতি চালু রাখতে হবে। একেবারে হাল ছেড়ে না দিয়ে তুমি পার্টটাইম চাকরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারো। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য উদ্যোগ নাও, তাহলে খুব ভালো হয়। ছাত্রনিবাসে বেশিক্ষণ না থেকে তুমি অনেকটা সময় কেন্দ্রীয় পাঠাগার এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলে সময় কাটাতে পারো। নিজের মনটিকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য অনেক রকম সুস্থচর্চার ব্যবস্থাও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তুমি চাইলে ধীরে ধীরে সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে বিভিন্ন ক্লাবগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারো। মা-বাবা তো তোমার সবচেয়ে বড় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তাঁদের কাছে কোনো একসময় যে ভুলটি করেছো, সে ব্যাপারে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখন থেকে মনটিকে প্রস্তুত করতে থাকো। আশা করি তাঁরা বুঝতে পারবেন তুমি মোহগ্রস্ত হয়ে এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলে। তাছাড়া এখন যে তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরে কতটা অনুতপ্ত হয়েছো, সেটিও আন্তরিকভাবে প্রকাশ করবে। দেখবে তখন অপরাধবোধের একটি মস্ত বড় বোঝা তোমার মন থেকে সরে যাবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৬, ২০১০
Leave a Reply