ঐশী নাওয়াল তন্ময় হয়ে বাবার কথা শোনে।
‘একাত্তরে আগস্টের মাঝামাঝি ঢাকায় ঢুকলাম। এর আগেও তিনবার ঢাকায় ঢুকেছি। এবার আমাদের সঙ্গে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। সঙ্গী ফতেহ আলী, বাকের আর কমল…।’
সেবার ঢাকায় আসার পর ঐশীর বাবা আবুল বারক্ আল্ভীর সঙ্গে তিন দিন দলনেতা বাকেরের দেখা হলো না। ভাবলেন, ফিরেই যাবেন মেলাঘরে; সেখান থেকেই তাঁরা আসতেন যুদ্ধ করতে। আলতাফ মাহমুদের এক বন্ধুও আল্ভীদের সঙ্গে যাবেন ওপারে, এ জন্য ২৯ আগস্ট সন্ধ্যায় আলতাফ মাহমুদের বাড়ি গিয়েছিলেন আল্ভী। বাড়িটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টো দিকে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় এ বাড়িতেই শয্যা। ভোররাতের দিকে ভারী বুটের আওয়াজ। পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনারা। অতঃপর সেনারা আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে যাঁদের ধরে নিয়ে গেল, তাঁদের একজন আল্ভী। এরপর নির্যাতন। ওরা জেনে গেছে, আল্ভী মুক্তিযোদ্ধা। বারবার অস্বীকার করার পরও নির্যাতন থামে না। কোথায় ওরা তথ্য পেল! রহস্যের ইতি ঘটল সামনে বাকেরকে দেখে। অসহ্য নির্যাতন করে বাকেরের কাছ থেকে ওরা স্বীকারোক্তি নিয়েছে।
আল্ভী বলেন, ‘বাকেরের ওপর আমার রাগ হলো না। তাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে, তাতে না বলে উপায় ছিল না ওর।’ এরপর আল্ভীর ওপর যে নির্যাতন চলল, তার বর্ণনা দিয়েছেন আল্ভী এভাবে, ‘শুধু এটুকু বলি, হাত-পা, শরীর ফেটে শার্ট-প্যান্ট রক্তাক্ত হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, চোয়াল ভেঙে গেছে, হাতের আঙুল নেই।’
‘বাবাকে ওরা অনেক কষ্ট দিয়েছে।’ ম্লান কণ্ঠে বলে ঐশী। ‘প্রথমে ওদের ওপর খুব রাগ হয়। জানেন, বাবার আঙুলগুলো ওরা থেতলে দিয়েছিল। আমার বাবা চিত্রশিল্পী। আঙুলের কারুকাজেই তিনি ছবি আঁকেন। সেই আঙুলগুলো…’। কথা বলতে কষ্ট হয় এ লেভেলের ছাত্রী ঐশীর। সামলেও নেয় নিজেকে, ‘বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার কান্না আসে, নিজেকে অসহায় মনে হয়। জানেন, এখনো শীতকালে বাবা ভারী কিছু তুলতে পারেন না হাতে। ব্যথা করে। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা—এ কথা ভেবে আমার গর্ব হয়। স্কুলে যখন বন্ধুদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হয়, তখন বাবার কথাও বলি। কী করে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন, কী করে আবার চলে গেলেন মেলাঘরে, এ কথাগুলো বলে বুকটা হালকা হয় আমার। মনে হয়, সেই যুদ্ধে আমিও ছিলাম।’
২.
কীভাবে স্বাধীনতা সঞ্চারিত হয় মনের ভেতর?
বই পড়ে? ছবি দেখে? স্মৃতিকথা শুনে? চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে অনুভবে এসে ধরা দেয় স্বাধীনতা?
তা নিশ্চয় দেয়। তবে একাত্তর নিয়ে আলোচনা হয় যদি পরিবারে, তখন কী হয়? পরিবারের কেউ যদি খুলে দেন স্মৃতির দুয়ার, তাহলে কি সেই স্মৃতি আরও বেশি গাঢ় হয়ে হূদয়ে মেশে না? তখন কি স্বাধীনতা অন্যের অর্জন হয়েই টিকে থাকে শুধু? নাকি নিজেরও মনে হয়, এই যুদ্ধে সরাসরি আমিও ছিলাম; ঐশীর যেমন হয়েছে?
প্রিয়তা নামে এক মেয়েকে জানি, শৈশব থেকেই যে শরীরে জড়িয়েছে বাংলাদেশের রং। ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরে ওর সঙ্গে দেখা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধে। ফ্রকপরা বয়সে ওর সবুজ ফ্রকে থাকত লালের কাজ। এরপর অবধারিতভাবে লাল সালোয়ার, সবুজ কামিজ। গত ১৬ ডিসেম্বরে দেখি সবুজ শাড়ি আর লাল ব্লাউজে সেজেছে; মাথায় বেঁধেছে জাতীয় পতাকা।
এই প্রিয়তার মতো অনেকেই নিশ্চয় বিশেষ দিনগুলোতে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় বিশেষ রঙে। তবে ওর কাছে শোনা কথাটি ভালো লাগল; বলল, ‘এই দুটি দিন বাবার সঙ্গে স্মৃতিসৌধে যাই। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি। প্রথম প্রথম স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে মা-বাবাই আমার পোশাক তৈরি করে দিতেন। এখন আমি বিশেষ দিনগুলোয় নিজেই আমার পোশাক পছন্দ করি।’
সাংবাদিকতার ছাত্রী প্রিয়তার বাবা লিয়াকত হোসেন ছিলেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতেই ও বড় হয়েছে।
৩.
চলছে নাচের ক্লাস। কিশোরী মেয়েরা এক দিকে, শিশুরা অন্য দিকে। কিশোরীদের নাচ শেখাচ্ছে সুদেষ্ণা স্বয়ংপ্রভা (তাথৈ)। সে একটি মুদ্রা দেখিয়ে দিচ্ছে, ওরা তা অনুকরণ করছে। মার মতোই নৃত্যশিল্পী তাথৈ। পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এখন আবার অভিনয়ও করছেন গৌতম ঘোষের মনের মানুষ চলচ্চিত্রে।
নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলি, ‘আপনার মেয়ে তাথৈকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন?’
‘মেয়ে তো সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনে। আমাদের বাড়িতে যখন-তখন কথা প্রসঙ্গে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ। চট্টগ্রামের রাউজানে ওরা আগুন লাগিয়ে দিল। আমরা উদ্বাস্তু। আগরতলা হয়ে ভারতে ঢুকলাম। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম শিবিরে, ক্যাম্পে। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, বেনু, শাহীনসহ অনেকেই একসঙ্গে ছিলাম আমরা। এসব গল্প বলি তাথৈকে।’
তাথৈ এসে বসে পাশে। ‘খাবার টেবিলেই হয়তো মা বলে, কত দিন না খেয়ে থেকেছে, কিংবা নয় দিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় টপকে আগরতলায় পৌঁছেছে, তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় মনে। বুঝতে পারি, কী কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে তারা! চুকনগরে যে গণহত্যা হয়েছিল, বাবা তো আরেকটু হলে সেখানে মারা যেত। বেঁচে গেছে, সেটাই তো অলৌকিক ঘটনা। বইয়ের চেয়ে তাদের কাছে শোনা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করে।’
তাথৈয়ের বাবা আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান একাত্তরের কথা। কীভাবে মার্চের শুরুতে বন্দুকের বিরুদ্ধে হাতে বানানো বোমা নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল খুলনার তরুণেরা, সে কথা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারেন না। বলে যান খুলনা থেকে বটিয়াঘাটা হয়ে ডুমুরিয়া যাওয়ার ঘটনা। কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে শুনতে পান চুকনগর হত্যাকাণ্ডের কথা। যারা বেঁচে ছিল, সেই সব আহত মানুষ আসছিল রক্তাক্ত দেহে।’
এই বিভীষিকা সঞ্চারিত হয় তাথৈয়ের মনে। তাথৈ ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে। তবুও ওর মনের শেকড়ে সঞ্জীবনী সুধা ছড়ায় বাংলাদেশের সংস্কৃৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাস। ও বলে, ‘আসলে সবকিছুই নির্ভর করে পারিবারিক সংস্কৃতির ওপর। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বর আমরা যে নাচ করি, গান করি, তা শুধু কণ্ঠের কারুকার্য ছড়ানোর জন্য নয়, হাত-পা সঞ্চালন করার জন্যই নয়; আমরা গান ও নাচের মাধ্যমে জীবনের অভিজ্ঞতাই বিনিময় করি। নইলে শিল্প সৃষ্টি হয় না।’
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি তাথৈকে একটি বাংলা কবিতা পড়তে দিয়েছিলাম। দেখলাম, একটা উচ্চারণও ভুল করল না। আমার মন ভরে গেল।’
৪.
এভাবেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে যায় স্বাধীনতা। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে সেই ইতিহাস জেনে নেয় পরের প্রজন্ম। সে সময়ের অভিজ্ঞতা চলে আসে এ সময়ে—কথোপকথনে। মনে হয়, দুই প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি সেতু। ঐশী যেমন বাবার থেতলে যাওয়া আঙুলের কথা ভেবে কষ্ট পায়, তাথৈ যেমন উপোস থাকা মায়ের কথা ভেবে কান্না লুকায়, তেমনি হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ প্রিয় যোদ্ধার কাছ থেকে নিয়েছে ইতিহাসের পাঠ; নিয়ে ঋদ্ধ হয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের রক্তস্রোতে। বলতে পেরেছে, স্বাধীনতা, তুমি সুন্দর; বলতে পেরেছে, তোমাকে ভালোবাসি।
জাহীদ রেজা নূর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৩, ২০১০
Leave a Reply