সংসারে যে মানুষটি সবচেয়ে ছোট, তারই জিনিসপত্তর কিন্তু সবচেয়ে বেশি। দুধের কৌটা, দুধের বোতল, খুদে বাটি-চামচ, দোলনা, তুলতুলে যত তোয়ালে, কতই না নরমসরম ছোট্ট জামাকাপড়, ঝুনঝুনি আর অন্তত শ-খানেক মন ভোলানো খেলনা—গুনতে গেলে শিশুর ব্যবহার্য জিনিসের ইয়ত্তা নেই। ঘরে না হয় আপনার হাতের কাছেই ইতিউতি থাকে সবকিছুই। তবে শিশুকে নিয়ে কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার প্রয়োজন হলে এত রাজ্যের জিনিস কি আর সঙ্গে নেওয়া যায়? আর শুধু ব্যবহার্য সামগ্রী নিলেই তো চলে না, ভ্রমণকালে শিশুর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নানা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে তবেই বেরোতে হয়। তাই ভ্রমণের আগে আপনার জন্য যেমন ব্যাগ গোছাতে হয়, শিশুর জন্যও চাই তেমন আলাদা গোছগাছ।
শিশুকে সঙ্গে করে ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে বেশ একটা হিমশিম খাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন আপনি, বিশেষ করে নতুন মায়েরা। মনে হতে পারে কোনটা ফেলে কোনটা নেবেন, সবটাই তো জরুরি। আবার বাদ পড়ে যেতে পারে আসল দরকারি জিনিসটাই। তাই প্রথমেই রাস্তায় কত ঘণ্টা থাকতে হবে, সেই হিসেবে কী কী প্রয়োজন হতে পারে তার একটা তালিকা তৈরি করে নিন। কোথাও গিয়ে কতক্ষণ বা কত দিন থাকতে হবে সে অনুযায়ীও তালিকায় জিনিসপত্র যোগ করুন। আর শিশুর জন্য নিন আলাদা একটা ব্যাগ। তারপর দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে করতে হবে গোছগাছ: ১. শিশুর সাধারণ ব্যবহার্য জিনিসপত্র, ২. শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক জিনিসপত্র।
জান্নাতুল ফেরদৌসের ছেলের বয়স দুই বছর। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অঞ্চল ভিত্তিতে পানির স্বাদটা কিন্তু একটু ভিন্ন্ন হয়ে থাকে। বাচ্চা যেখানকার যে স্বাদের পানি খেয়ে অভ্যস্ত তার অন্যথা হলে পানি অনেক সময় খেতে চায় না অন্য জায়গায় গিয়ে। তাই ভ্রমণের সময় চেষ্টা করি ছেলের জন্য কয়েক বোতল বাসায় ফুটানো পানি নিয়ে যেতে।’
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশুবর্ধন ও পরিচর্যা বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদা বেগম বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো খাবার পানি। সঙ্গে করে অবশ্যই বিশুদ্ধ ফুটানো পানি নিতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। রাস্তার জন্য সঙ্গে রাখতে হবে শিশুর বাড়তি কয়েক সেট কাপড়। ব্রাশ-টুথপেস্ট, তোয়ালে, রুমাল, টিস্যু ও কয়েকটা ডায়াপার নিয়ে নিতে হবে ব্যাগে। শিশুর খাবারদাবারের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিশু পছন্দ করে এমন শুকনো খাবার যেমন ঘরে তৈরি পিঠা কিংবা বিস্কুট রাখুন সঙ্গে। বাইরে বেরোলে বাচ্চারা বিরক্ত করতে পারে। তখন তাকে ভুলিয়ে রাখতে তার পছন্দের দু-একটা খেলনাও নিন। কয়েক দিনের জন্য কোথাও গেলে শিশুদের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে জায়গা বদলে। সে ক্ষেত্রে তার নিজস্ব পরিবেশের আমেজ দিতে শিশুর ঘুমের সময় ব্যবহূত নিজের কিছু যেমন কাঁথা, বালিশ, কোনো একটা খেলনা ইত্যাদি নিতে পারেন সঙ্গে, জানান তিনি।
আর সব জিনিসের সঙ্গে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে শিশুর ভ্রমণকালীন সুস্থতা। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহাবুব মোতানাব্বি বলেন, ‘মূলত তাপমাত্রার তারতম্য এবং খাদ্যগ্রহণে অসাবধানতার কারণে ভ্রমণকালে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। দূরপাল্লার যাত্রায় শিশু অনেক সময় আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। আর আমাদের দেশে এই সময়টায় বেশ গরম থাকে, তাতে যাত্রাকালে শিশুর ঘাম বেশি হয়ে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।’ এসব সমস্যা এড়াতে তাঁর পরামর্শ:
যানবাহনে জানালার পাশে শিশুকে বেশিক্ষণ বসতে দেবেন না। অনেকক্ষণ খোলা বাতাসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, ধুলোবালিও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। বেশিক্ষণ শিশুকে রোদে রাখা যাবে না।
রাস্তায় কবার শিশুর জামা পাল্টে দিন গরমকালে। নরম কাপড়ের ঢিলেঢালা পোশাক পরান।
শিশু ঘেমে গেলে ঘাম গায়েই শুকিয়ে যাওয়ার আগে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিন।
রাস্তায় শিশুকে ঘরে বানানো খাবার খাওয়ানোটাই ভালো। বিশুদ্ধ খাবার পানি পান করান। সেই পানি দিয়েই খাবার পাত্র ও হাত ধুয়ে নিন খাওয়ার আগে।
যানবাহনে বা নতুন জায়গায় শিশুরা অনেক সময় প্রস্রাব আটকে রাখে, যা তাদের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে প্রথম একবার অভিভাবকেরা তাদের নিয়ে টয়লেটে যান যাতে নতুন পরিবেশটা তাদের জন্য সহজ মনে হয়। পটি ব্যবহারে অভ্যস্ত শিশুদের জন্য তাদের পটি সঙ্গে নিতে পারলে ভালো।
অসুস্থ শিশুকে নিয়ে ভ্রমণে তো বটেই, তা ছাড়া এমনিই কিছু ওষুধপত্র সঙ্গে নিলে খুব ভালো হবে। বুঝে নিন পথে শিশুর কী ধরনের সমস্যা হতে পারে ও কী জাতীয় ওষুধ সঙ্গে নেবেন।
পাতলা পায়খানা
খাওয়াদাওয়ার গোলমালে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণে শিশুদের এমনটা হতে পারে ভ্রমণকালে। এ ক্ষেত্রে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতেই হবে শিশুকে। প্রতিবার পায়খানার পর একেবারে ছোট শিশুদের ৫-১০ চামচ, বছর দুয়েকের শিশুদের ২০ চামচ পরিমাণ স্যালাইন খাইয়ে দিন। তবে প্রস্রাব কম হলে আরও বেশি পরিমাণ স্যালাইন খাওয়াত হবে। লক্ষ রাখুন, একবার প্রস্রাবের পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে শিশুর আরেকবার প্রস্রাব করা উচিত। শিশু যাতে ছয় ঘণ্টার বেশি প্রস্রাব না করা অবস্থায় না থাকে।
কোষ্ঠ্যকাঠিন্য
খাওয়ার অনিয়মে বা পানি কম খেলে এমনটা হতে পারে। প্রচুর পানি পান করাতে হবে শিশুকে। সঙ্গে ইসবগুলের ভুসি রাখতে পারেন এ অবস্থার জন্য।
কাটা-ছেঁড়া
অ্যান্টিসেপটিক ও ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ (যেমন ব্যান্ড-এইড) জাতীয় কিছু সঙ্গে রাখুন। যেখানে কেটে বা ছিলে গেছে তা ভালো পানি দিয়ে ধুয়ে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম দিয়ে অংশটুকু উন্মুক্ত না রেখে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিন।
জ্বর
সঙ্গে থার্মোমিটার নিন। দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি হলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এর চেয়ে বেশি হলে ভিজে কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে শিশুর গা মুছিয়ে দিন। ঠান্ডা নয়, স্বাভাবিক পানিতে তোয়ালে ভেজালেই হবে। প্যারাসিটামল জাতীয় সিরাপ রাখুন সঙ্গে। সিরাপের নির্দেশিকা অনুসারে বাচ্চাকে এক বা দুই চামচ দিন জ্বর বেশি হলে।
কাশি
বাসা থেকে একটু আদা কুচি করে নিয়ে নিতে পারেন সঙ্গে। বাজারে কাশির জন্য বাসক পাতাসমৃদ্ধ সিরাপ পাওয়া যায়, একটা সঙ্গে রাখতে পারেন।
সর্দি
কখনো হাত দিয়ে নয়, টিস্যু দিয়ে নাক মুছে দিন। নাক বেশি বন্ধ থাকলে ‘নরমাল স্যালাইন ড্রপ’ রাখুন কাছে, কটন বাড দিয়ে পরিষ্কার করে দিন শিশুর নাক। অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ রাখতে পারেন সঙ্গে।
ফারাহ শাম্মা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৩, ২০১০
Leave a Reply