পড়ন্ত দুপুরে মাটির সানকিতে ভাত, ভর্তা, সবজি, মাছ, সাজিয়ে আঁচলে ঢেকে বধূ চলেছেন খেতের আল ধরে। তাঁকে দূর থেকে দেখে গরু নিয়ে হাঁট্ হাঁট্ করতে থাকা কিষানের মুখে ফুটে উঠল হাসি। এগিয়ে এল বধূটির পানে। গাছের ছায়ায় বসে আঁচলে সানকি পেতে বধূ ভাত সাজিয়ে দিল কিষানের সামনে। মাটির সানকিতে পরিবেশন করা ভাত যেন কিষানের কাছে অমৃত… গ্রামীণ এ চিরাচরিত দৃশ্য সবারই জানা। নাগরিকজীবনে অভ্যস্ত আমরা চাইলেই কিন্তু দেশীয় এ রূপটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারি আমাদের খাবারের টেবিলে। মুখে যা-ই বলি না কেন, মনে প্রাণে তো আমরা সবাই মাছে-ভাতে বাঙালি, তাই না?
আপনার নিত্যদিনের পরিচিত খাবারের টেবিলটা বদলে ফেলুন, সাজিয়ে তুলুন দেশে তৈরি তৈজসপত্রে। চমকে দিন আপনার পরিবারের সবাইকে, একদিন সকালে নাশতার টেবিলে অথবা দুপুরের আহারে।
টেবিলে সাজিয়ে দিন মাটির তৈরি তৈজসপত্র। গ্রামীণ কিষাণির মাটির সানকিতে তৈরি খাবার সবার নজর কাড়বে। বলছিলেন, রেডিয়েন্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার গুলশান নাসরিন চৌধুরী। মাটির বড় বাটিতে রাখতে পারেন ভাত। গরম রাখতে চাইলে মাটির ঢাকনাওয়ালা পাত্রে ঢেকে রাখতে পারেন। এর সঙ্গে কাঠের বা নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি চামচ ব্যবহার করতে পারেন। চামচগুলো সাজিয়ে রাখতে পারেন বাঁশের কোনো স্ট্যান্ডে, টেবিলের একপাশে। মাটির মগ বা বাঁশের গ্লাসও এর সঙ্গে চমত্কার দেখাবে।
যে সময় ফ্রিজের প্রচলন হয়নি, গ্রামের মানুষ মাটির কলসিতে পানি রাখত ঠান্ডা থাকার জন্য। তাই ফ্রিজে রাখা পানি বাদ দিয়ে বড় একটা মাটির জগে পানি রাখতে পারেন। বারবার ফ্রিজ খোলার ঝামেলা থাকবে না। মাটির লবণদানিতে লবণ রাখুন। খাবারের টেবিল সাজানোর আগে যে ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসবেন, সেটা হতে পারে কাঠের বা বেতের। রিকশা পেইন্টিংয়ের খুব সুন্দর ট্রে পাওয়া যায় বাজারে, তা থেকে কিনে নিতে পারেন। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত আমাদের চা ছাড়া যেন চলেই না। চায়ের পরিবেশনটাও হতে পারে মাটির কাপ, পেয়ালা অথবা নারকেলের মালার কাপে, সঙ্গে মিষ্টি বা ফিরনি দিতে বেছে নিন মাটির হালকা গর্তওয়ালা পেয়ালা। বললেন, গুলশান নাসরিন চৌধুরী।
রান্নাবিদ রাহিমা সুলতানা বললেন, মানুষের ক্ষুধা প্রথমে চোখে, তারপর পেটে। তাই চোখে ভালো লাগাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশনের কারণে খাবার হয়ে ওঠে অনেক সুস্বাদু। পরিবেশনকারীকে তাই তার চোখ দিয়ে দেখতে হবে, পরিবেশনটা কীভাবে সুন্দর করা যায়। বাটি ভরে পরিবেশন না করে, বাটির চারভাগের তিনভাগ পরিবেশন করতে হবে। কী ধরনের খাবার, তার ওপর নজর দিতে হবে। খাবারে ঝোল থাকলে একটু গর্তওয়ালা বাটিতে পরিবেশন করতে হবে। ভাত খুব গর্ত না আবার ছড়ানোও না—এমন পাত্রে পরিবেশন করা যেতে পারে। খুব ছড়ানো, চ্যাপটা পাত্র টেবিলের অনেক জায়গা দখল করবে। এদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। টেবিলের মাঝখানে ভাতের পাত্র আর তার চারপাশে ভর্তা, তরকারি, মাছ, মাংসের বাটি রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উঁচু থেকে নিচু করে বাটিগুলো সাজাতে পারেন। গুলশান নাসরিন চৌধুরী খাবারের টেবিলের পাশাপাশি খাবারের ঘরে রঙের খেলাটাও ছড়িয়ে দিতে পরামর্শ দেন। খাবারের ঘরের দেয়ালটা তিন দিকে চাপা সাদা এবং একদিকে হালকা কমলা করা যেতে পারে। এর সঙ্গে মাটির থালা-বাটিটা মানিয়ে যাবে বেশ। খাবারের টেবিলের ঢাকনাটা হতে পারে তাঁতের তৈরি। অথবা সুতি কাপড়ে ব্লক-বাটিক করিয়ে নিতে পারেন। তার সঙ্গে মিলিয়ে ন্যাপকিন ও ম্যাট রাখতে পারেন। ছনের ও বেতের তৈরি ম্যাট দিয়ে বৈচিত্র্য আনতে পারেন। চটের ম্যাটও ব্যবহার করতে পারেন। টেবিলের মাঝখানের ম্যাটটা বেতের হতে পারে, তাতে রঙিন সুতার নকশা থাকতে পারে।
মাটিতে বসে খাওয়ার জন্য গ্রামে একসময় দস্তরখানা বিছানো হতো। সেটা টেবিলের মাঝখানে বিছিয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে পারেন। এর সঙ্গে মিলিয়ে তাঁতের কাপড়ের তৈরি ঢাকনা চেয়ারে লাগাতে পারেন। একটা সময় ছিল গ্রামবাংলায় কাঁসার তৈজসপত্র ব্যবহার করা হতো। তারও আগে মানুষ কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করত। রাহিমা সুলতানা এ দুটি মিলিয়ে ভিন্নভাবে খাবার পরিবেশনের কথাও বললেন। কাঁসার প্লেটে কলাপাতা বিছিয়ে খাবার সাজাতে পারেন। কলাপাতা বিভিন্ন আকৃতিতে কেটে তরকারি, মাছ সাজাতে পারেন তাতে। কাঁসার প্লেটের সঙ্গে বাটি ও চামচ ব্যবহার করুন। আর ম্যাট হিসেবে উপজাতিদের তৈরি কাপড়ের ম্যাট ব্যবহার করুন। টেবিলের মাঝখানে কাঁসার ছোট পাত্রে রাখতে পারেন সলতে দেওয়া প্রদীপ।
খাবারের টেবিলের মাঝখানে রাখতে পারেন মাটির মোমদানিতে মোমবাতি। এ ছাড়া টেবিলের ওপর ঝুলিয়ে দিতে পারেন হালকা আলোর কোনো ল্যাম্প। বাঁশ-বেতের তৈরি ল্যাম্পশেডের আলো আপনার খাবার পরিবেশনকে আরও সুন্দর করে তুলবে। টেবিলের মাঝখানে বাঁশের ঝুড়িতে রেখে দিন কিছু রঙিন ফল। ফুলই বা বাদ যাবে কেন? মাটির বা বাঁশের তৈরি ফুলদানিতে রাখুন কিছু তাজা ফুল।
আপনার খাবারের টেবিল সাজানোর দেশি তৈজসপত্র আর মজার উপদানগুলো পাবেন আড়ং ও যাত্রার সব শাখায়। এ ছাড়া আইডিয়াস, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটের ভার্টিকেলসহ শিশু একাডেমীর সামনের চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের দেশি জিনিস।
মাটির থালা ৭০-১২৫, মাটির বোল ১২০-১৭৫, চায়ের কাপ ৫০-৭৫, মাটির বাটি ৬৫-৮০, পট ১৬৫, ফিরনি পেয়ালা ৭৫, লবণদানি ৭৫-১৩৫, জগ ১৩৫, মাটির ঢাকনা ১০-২০, কাঠের প্লেট ৩০০-৫০০, ট্রে ৬৫০-৭৫০, চামচ ২০০-২৫০, বাটি ২৯৫, বোল ৪৫৫, নারকেলের খোলের তৈরি চামচ ৫০, চা সেট ৩৫০, বেতের ট্রে ১৫০-৩৫০, কাঠের ট্রে ২৫০-৫৫০, বেতের ঝুড়ি ৬০, বেতের ট্রে ১৯৮, কাঁসার প্লেট ২৫০-৩৫০, বাটি ২৭৫-৩০০, পান-সুপারিদানি ১৬৫, কাঁসার ঘটি ১৬৮-৫৮৬, ছনের ম্যাট ২৯৫, উপজাতিদের কাপড়ের ম্যাট ৩২৫, খাদি ম্যাট ২৯৪, চটের ম্যাট ১০০-১৫০, বাঁশ-বেতের ল্যাম্প ৩৫০-৭৫০, টেবিল কভার তাঁতের ৫৫০-৮৫০, টেবিল কভার হাতের কাজ ১০৫০-১৫০০, মাটির ফুলদানি ২৫-৭০ ও বাঁশের ফুলদানি ৬৫-১৫০ টাকায় পাওয়া যাবে।
শান্তা তাওহিদা
মডেল: দিহান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৬, ২০১০
Leave a Reply