‘মহত্ শিল্পীরা নিজেদের কাজে অন্তর্নিহিতকরণ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধহস্ত বলেই যেকোনো শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে অন্য মাধ্যমের অন্তর্গত সাদৃশ্যটুকু সম্ভব হয়। তীব্র মানসিকতা রেমব্রান্টের ছবিতে দেখা যায় যেটা প্রায় একই তীব্রতা নিয়ে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গ্যয়টের নাটকে, বেথোফেনের সুরে অথবা জয়নুলের ছবিতে। মহত্ শিল্পী নিজেদের শিল্পে নিজেদের রীতিতে জগতের অদৃশ্য গভীর সত্যকেই উপস্থাপিত করেছেন, যার ফলে জীবন নতুন অর্থে উদ্ভাসিত হয়।’
কথাগুলো কাজী হাসান হাবিব লিখেছিলেন ১৯৮৫ সালে তার দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীর পুস্তিকায়। জীবনের অর্থ এবং জগতের অদৃশ্য গভীর সত্য—এই দুইয়ের অন্বেষা একান্ত নিজের মতো করে পাওয়া যাবে হাসান হাবিবের নিজের শিল্পকর্মেও।
কাজী হাসান হাবিবের জন্ম ১৯৪৮ সালে আর মৃত্যু ১৯৮৮ সালে। সত্তর দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ—এই সময়জুড়ে শিল্পী রচনা করেছেন বেশ কিছু চিত্রকর্ম। এরই কিছু অংশ নিয়ে বনানীর গ্যালারি জলরংয়ে শুরু হয়েছে কাজী হাসান হাবিবের একক চিত্র প্রদর্শনী।
প্রায় ১৪৫টি চিত্র রয়েছে প্রদর্শনীতে। এই শিল্পীর কাজে বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষের উপস্থিতি প্রবল। রয়েছে পেইন্টিং এবং পেনসিল, কলম ও তুলিতে করা ড্রইং। হাসান হাবিবের কাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ড্রইং; অল্প রেখায় নারী শরীরের সুডৌল গড়ন প্রকাশবাদিতার পরিচয় দেয়। আধাবিমূর্ত রীতিতে করা প্রকৃতি এবং মানুষের সম্মিলিত প্রকাশ রয়েছে কিছু কাজে। আবার অল্প কিছু ছবিতে ছন্দায়িত রেখা এবং অলংকারধর্মিতা লোকআঙ্গিকের পরিচয় দেয়। তবে মূর্ত বা বিমূর্ত হোক আর ড্রইং বা পেইন্টিং হোক—সবই যেন ক্যানভাস বা কাগজের ওপর রঙ, রেখা বা গড়নের একটু ছোঁয়া। যেটুকুর জন্য তাঁর ছবি ছবি হচ্ছে এবং শুধু সেইটুকুর অভাবে তার ছবি ছবি নাও হতে পারত। চিত্রপটের বেশ কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়ে অল্প কিছু রঙ, রেখা ও গড়নের উপস্থিতি একটি ভিন্ন প্রকাশভঙ্গির জন্ম দিয়েছে। যাকে বলা যায় উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতির সম্মিলিত উপস্থাপন। ড্রইংয়ের অল্প রেখা পুরো শরীরকে দৃশ্যমান করে তোলে, যা প্রকৃতপক্ষে চিত্রে অনুপস্থিত। অনেকটা প্রকাশবাদী ভঙ্গিতে করা এই ছবিগুলো অন্য অর্থে গভীরতার দ্যোতনা তৈরি করে। যে গভীরতা জীবনের সত্য এবং যা চিরস্থায়ী।
সহজের মধ্যে স্থায়িত্ব খোঁজার এই প্রচেষ্টা হাসান হাবিবের ছবির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে। শিল্পীর নিজের কথায়ই এর প্রমাণ মেলে। ১৯৮২ সালে অনুষ্ঠিত তাঁর একক প্রদর্শনীর পুস্তিকায় তিনি লিখেছিলেন—“আমার কৈশোরের স্মৃতি, সেই আকাশ, আলো-ছায়া, রঙ ক্যানভাসে ধরতে চেষ্টা করেছি। মাঠের শিয়রে চাঁদ। নির্জন সময় চমত্কার গান গায়। ঘনিষ্ঠ আকাশ জ্যোত্স্নার ভিতরে অপলক চেয়ে থাকে। এরাই দিনরাত্রি বারোমাসে ঘুরে ফিরে আসে। আমার ইচ্ছা—এমন একটা ‘চিরকাল’ আমার ক্যানভাসের সীমিত আকাশে, ধরে রাখার।”
রোমান্টিক কিন্তু পরিমিত আবেগের এই প্রকাশ শিল্পীর প্রতিটি চিত্রে স্পষ্ট, যেখানে চিত্র নির্মাণের উপাদান—রঙ, রেখা, ফর্ম, স্পেস, ভলিউম, আলো-ছায়া প্রভৃতির সুচিন্তিত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগ চোখে পড়ে। এই অন্বেষা কাজী হাসান হাবিবের ছবিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
প্রদর্শনী চলবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত।
মাসুদা খাতুন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১২, ২০১০
Leave a Reply