হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় প্রিয় মানুষটির স্পর্শ। তার মাঝে রয়েছে নির্ভরশীলতা। পারস্পরিক সমঝোতা। হাসি-আনন্দে ভরা সাধারণ জীবনটিকে মনে হয় অসাধারণ। কীভাবে সময় কেটে যায়, বোঝাই যায় না। বিশ্বাস আর ভালোবাসার জালে বোনা এমন সম্পর্কই অনেক সময় ভেঙে যায়। তখন এর প্রভাব পড়ে সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলোর ওপর। প্রিয়জন হারানোর শূন্যতা গ্রাস করে। জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয় তখন। একাকীত্বের ঘেরাটোপে থমকে যায় সময়। সাময়িকভাবে স্থবির হয়ে পড়ে সবকিছু। এই কষ্ট অবর্ণনীয়।
তবে এই কষ্ট যেন পাথর হয়ে চেপে না বসে। জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। দীর্ঘদিনের একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানেই জীবন থমকে যাওয়া নয়। তবে কষ্ট তো হবেই। এ রকম অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় দিতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের মাত্রাটা কমে আসে, তখন বাস্তব চিন্তাগুলো করা সম্ভব হয়। আবেগপ্রবণ হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। জানান নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের। তিনি বলেন ‘তরুণ প্রজন্মের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
তারা একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে দ্রুত আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসার নির্ভরশীলতা খোঁজে। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভুল হয়। ভবিষ্যতে সেজন্য তাকে আবার কষ্ট পেতে হয়। একসময় নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। দুর্ঘটনা ঘটে। তাই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা উচিত। কষ্ট হলেও সময় নেওয়া উচিত।’
সময়ই সবচেয়ে বড় ওষুধ
তিনি আরও বলেন, জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। এটি সম্ভব যদি সে সবার সহযোগিতা-সহানুভূতি পায়। বিশেষ করে পরিবারের। তাকে বিশেষ কাছের কারও কাছে মনের কথা খুলে বলতে হবে। তবেই অন্যরা সাহায্য করতে পারবে। একটি সম্পর্ককে কেন্দ্র করে দুটি মানুষ একে অপরের অবলম্বন হয়ে ওঠে। সেটি হারিয়ে গেলে শূন্যতা অনুভব করে। গভীর এ কষ্ট কাটিয়ে উঠতে নতুন অবলম্বন তৈরি করে নিতে হবে। তা নিজের পরিবার থেকেও শুরু হতে পারে। সব সময় মানুষের মধ্যে থাকা উচিত। অন্যদিকে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে কষ্টটা একটু হলেও ভুলে থাকা যায়। সময়ের পরিবর্তনে জীবনে পরিবর্তন আসে। শোক কাটিয়ে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করা সম্ভব।
আবার হুট করেই কোনো সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া উচিত নয়। টিকিয়ে রাখতে না চাইলে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসা উচিত। এতে দুজনের কষ্ট কম হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ার সময় দিতে হবে। তাহলে পরে এই পরিস্থিতি সামলিয়ে নেওয়া তার জন্য সহজ হয়। মনে করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রেহান।
নিজেকে ভালোবাসুন
‘প্রতিটি সর্ম্পকই আবেগের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে আমরা নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাই। ভালোবাসতে গিয়ে ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিই। সে কারণে ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়ি। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। তাই প্রতিটি মানুষের উচিত নিজের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে শরীর ও মন দুটোর দিকেই সমান যত্নবান হতে হবে। আগে থেকে এই প্রস্তুতি নিলে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। চাইলেও শোকের মুহূর্তগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। সে কারণে নিজেকে সব সামলানোর সময় দিন। নিজের প্রতি প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিন। আপনার সমস্যাটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করুন। এতে করে তারা বুঝতে পারবে। অযথা হয়তো আপনাকে বিরক্ত করবে না। এই ধাক্কা ও কষ্টকে সবাই তখন শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। নিজের প্রতি যে খারাপ লাগা ছিল তা কমে যাবে।’ কথাগুলো বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম।
ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলুন
তাত্ক্ষণিকভাবে,ব্যক্তিত্বের অসামঞ্জস্যতা ও চাহিদার পূর্ণতা-অপূর্ণতাসহ নানা কারণে সম্পর্ক ভেঙে যায়। সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষটি দূরে সরে যায়। এ সময় মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হতাশা গ্রাস করে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। জীবনটা আনন্দহীন মনে হয়। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভালোবাসায় ব্যর্থতা আসবে, জটিলতা আসবে। এসব অতিক্রম করে যাওয়াই জীবন। সেজন্য ইতিবাচক মনোভাবা্পন্ন হতে হবে। জানান মনোচিকিত্সক ও কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল। নিজের সমস্যাটি নিয়ে প্রথমেই উচিত কারও সঙ্গে আলোচনা করা। তাতে করে মনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। তবে ‘সুপ্রিম সাইকিয়াট্রিক ইমার্জেন্সি’ দেখা দিলে মনোচিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে। আসল কথা হলো নিজের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন। দেখবেন নিজেই পারছেন এ পরিস্থিতি সামলিয়ে উঠতে। সামনে আনন্দভরা দিন অপেক্ষা করছে।
মনে রাখবেন
প্রথমেই উচিত কাছের কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা।
পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। তারা বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা না করে তাকে বোঝার চেষ্টা করবে।
তার ভালোলাগার দিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাকে পুরোপুরি সমর্থন দিতে হবে।
নিজের প্রতি খেয়াল তৈরি করুন। পাশাপাশি নিজের জীবনকে ভালোবাসতে শিখুন।
মানুষের মাঝে থাকার চেষ্টা করুন। পরিবারকে সময় দিন।
বন্ধুদের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটান।
কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন।
সিনেমা দেখতে যাওয়া, কেনাকাটা করা সম্ভব হলে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন।
সম্ভব হলে কাজের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করুন। সময়ও কাটবে,কর্মজীবনও সফল হবে।
আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।
তৌহিদা শিরোপা
মডেল: রাহা ও অপু স্বপ্নে ঘেরা চারপাশ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৯, ২০১০
Leave a Reply