ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। মাঝেমধ্যে আমি হীনম্মন্যতায় ভুগি। নিজেকে খুব ছোট ও অস্বাভাবিক মনে হয়। পৃথিবীর কারও সঙ্গে আমার কোনো মিল খুঁজে পাই না। স্বাভাবিক কোনো কাজকর্ম করতে পারি না। স্বাভাবিকভাবে কারও সঙ্গে মিশতে পারি না। আমার মনটা খুব ছোট হয়ে যায়, মনে হয় একটা বিশাল পাথর আমার মনকে চাপা দিয়ে রাখে। আমি সবকিছু করতে চাই কিন্তু পারি না। আমার স্মার্টনেস ভেতরে ভেতরে কাজ করে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। আমার প্রতি সবার আচরণ নেতিবাচক মনে হয়। কারও সঙ্গে তর্কে বা কোনো প্রতিযোগিতায় হারলে সেটা আমি সহজে মানতে পারি না। মনে হয়, আমি কিছুই পারি না; আমি বিবেক-বুদ্ধিহীন। পৃথিবীর কোনো কিছুই ভালো লাগে না; এ জীবন ভালো লাগে না। তখন মনে হয়, এ জীবন রাখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো এবং মরে যেতে খুব ইচ্ছে হয়। কোনো ভুল করলে সারাক্ষণ এটা নিয়ে ভাবি এবং কষ্ট পাই। সর্বোপরি নিজেকে মনে হয় ব্যক্তিত্বহীন। প্রায় দুই বছর ধরে এ সমস্যা হচ্ছে। আগে আমি খুবই উচ্ছল ছিলাম। এখন মাঝেমধ্যে মাসের প্রায় অর্ধেকটা সময় আমার এভাবে কাটে। বাকি দিনগুলো আমি খুব উচ্ছল, স্মার্ট থাকি। সবকিছু করতে পারি।
মৌ, সিলেট।
পরামর্শ: তুমি যে মাঝেমধ্যে বিষণ্নতায় চলে যাচ্ছ এবং আবার উচ্ছ্বাস বোধ করছ—এটার কি কোনো ধারাবাহিকতা রয়েছে? তুমি লিখেছ, এই উপসর্গগুলো দুই বছর ধরে চলছে। আমাদের সবারই কমবেশি মুডের ওঠানামা হয়, তার পরও জীবনের চাহিদাগুলো ক্রমাগত মেটাতে গিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে প্রতিদিন আবার নতুন করে উদ্যম তৈরি করি। এই উত্সাহ-উদ্দীপনা নিজের মধ্যে তৈরি করতে গিয়ে যদি আমাদের মনে হয়, এর ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই অর্থাত্ নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস কাজ করছে না, তাহলে বুঝতে হবে, আমার মস্তিষ্কের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কিছু ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। খুব বেশি বিষণ্নতা থেকেই নিজের ক্ষতি করার ভাবনাটি ঘোরাফেরা করতে থাকে। আবার হঠাত্ একদিন সবকিছু খুব বেশি ভালো লাগতে শুরু করলে সেটাও খুব স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে না। হঠাত্ করেই খুব খুশি লাগে, প্রচুর প্রাণশক্তি আর কর্মক্ষমতা অনুভব করতে থাকি, রাতে ঘুম না হলেও কাজ করতে অসুবিধা হয় না। এটিও মস্তিষ্কের কোষের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা নির্দেশ করে। এটিকে বাইপোলার বা মুড ডিসঅর্ডার বলা হয়। তোমার এই মানসিক অসুবিধাটি তৈরি হওয়ার জন্য জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণ—দুটিই থাকতে পারে। এর জন্য নিজেকে কোনোভাবেই দোষারোপ করবে না, কেমন? তোমার পরিবারের সদস্যদেরও বুঝতে হবে যে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ এবং তোমার চিকিত্সার প্রয়োজন রয়েছে। তোমাকে তো দৈনন্দিন কাজগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে পড়ালেখায়ও মনোযোগী হতে হচ্ছে নিজেকে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কাজেই দেরি না করে ঢাকায় এসে চিকিত্সা নাও। প্রথমে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাইকোথেরাপি নিলে তিনি বুঝতে পারবেন, তোমার ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে কি না। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী তুমি মনোরোগ চিকিত্সকের সাহায্য নিলে আশা করি অনেক সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে পারবে।
সমস্যা: আমার বয়স ২০ বছর। আমি গ্রামের একটি কলেজ থেকে পাস করি। সেই কলেজে পড়ার সময় আমি আমার এক ক্লাসমেটকে মনে মনে খুব ভালোবেসে ফেলি। এবং একসময় আমরা দুজন খুব বন্ধু হয়ে যাই। কিন্তু মেয়েটিকে আমি কখনোই মুখে বলিনি যে তাকে আমি ভালোবাসি। আকার-ইঙ্গিতে সব বুঝিয়েছি। আমার পরিবারের বাবা বাদে সবাই জানে, আমি সেই মেয়েটিকে ভালোবাসি এবং সেই মেয়েটিরও বান্ধবী ও নিকটাত্মীয় জানে, তাকে আমি পছন্দ করি। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে আলাপ হয় এবং বছরের বিশেষ দিনে যেমন, ঈদে তার সঙ্গে দেখা হয়। সে এখন কলেজে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার কী করা উচিত?
আমিনুল
মিরপুর, ঢাকা।
পরামর্শ: ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার আগেই মেয়েটিকে তুমি প্রেমিকের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিলে। তবে পরবর্তী সময়ে তোমরা যে খুব ভালো বন্ধু হয়েছ সেটা খুবই প্রশংসনীয়। মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তুমি তার সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুর মতো আচরণ করতে সক্ষম হয়েছ। এর অর্থ হচ্ছে, তোমার নিজের আবেগের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে। মেয়েটি কি এত দিনে একটুও বুঝতে পারেনি যে তুমি তাকে ভালোবাস? বাবা ছাড়া তোমার বাড়ির সবাই ব্যাপারটি জানে-শোনে বলে মনে হচ্ছে। বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে তোমার একটি সুন্দর আবেগীয় যোগাযোগ রয়েছে। বাড়িতে এমনই একটি খোলামেলা পরিবেশ থাকলে সবাই মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারে। কারণ এতে যথেষ্ট মানসিক সহায়তা পাওয়া যায়। তবে তুমি যেহেতু এখন প্রাপ্তবয়স্ক; এবং মেয়েটির সঙ্গে একটি সুস্থ বন্ধুত্ব রয়েছে, তুমি তো এখন সুন্দরভাবে তোমার অনুভূতির কথা ওর কাছে প্রকাশ করতেই পারো।
তবে ওর দিক থেকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা-ই উত্তর আসুক না কেন, তুমি দুই পরিস্থিতির জন্যই নিজেকে আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেবে। তোমার যেমন ওকে শুধু বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অধিকার রয়েছে, ওরও ঠিক তেমনিভাবে তোমাকে ওর নিজের মতো করে দেখার অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারটি আগে নিজেকে খুব ভালোভাবে পুরোপুরি বোঝাতে পারলে পরবর্তী সময়ে তোমার মনটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কমে যাবে। অনেক শুভকামনা রইল তোমার জন্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৬, ২০১০
Leave a Reply