বায়ান্নর মিছিলে তথ্যচিত্র তৈরির কাজে রোকেয়া প্রাচী গিয়েছিলেন ভাষাশহীদ আবুল বরকতের গ্রামে। পশ্চিমবঙ্গের বাবলা গ্রামে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
কাজের সূত্রেই পরিচয় এম আর এ তাহা নামের মানুষটার সঙ্গে। ভদ্রলোক ব্যবসা করেন। একদিন কথায় কথায় জানতে চাইলেন, বরকতকে নিয়ে কিছু করা যায় কি না। রোকেয়া প্রাচী তখনো জানেন না এ মানুষটিই আমাদের ভাষাশহীদ বরকতের মামাতো ভাই। মনে মনে এমন একটা বিষয় নিয়েই কাজ করার কথা হয়তো ভাবছিলেন তিনি। কিন্তু ভাবনাটাই সব নয়। অনেক খুঁজে পেতে মিলল শুধু বরকতের একটি ঝাপসা ছবি এবং তাঁর নিজের হাতে লেখা কয়েকটি চিঠি। এটুকু সম্বল করে আর যা-ই হোক সত্যিকার কোনো তথ্যচিত্র দাঁড় করানোটা অসম্ভব। বইপত্র ঘেঁটে বরকত সম্পর্কে যেটুকু তথ্য মিলল, সেটাও যথেষ্ট নয়। নতুন কিছুর সন্ধান দিতে পারে বরকতের জন্মভিটে। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের এক গ্রাম বাবলা। ওই গ্রামেই জন্মেছিলেন আমাদের ভাষাশহীদ আবুল বরকত।
২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পথে রওনা হওয়ার আগেই বিপত্তি। ভিসা জটিলতার কারণে যাওয়া হচ্ছে না ক্যামেরাম্যানের। আর দালালের খপ্পরে পড়ে সময়মতো ভিসাই পেলেন না আরেক সহকারী। কিন্তু তখন আর পিছু ফেরার সময় নেই। রোকেয়া প্রাচী বাবলা গ্রামের পথে রওনা হলেন একাই।
‘আমি কলকাতায় গিয়ে পৌঁছালাম ২০ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় গিয়ে যখন নামলাম, তখন রাত আটটা। ওখানে খানিক বিশ্রাম আর খাওয়া-দাওয়া সেরে ওই রাতেই রওনা হলাম আবার। ততক্ষণে কোনোমতে কলকাতা থেকেই ক্যামেরাম্যান সন্দীপনকে জোগাড় করে ফেলেছি। কলকাতা থেকে বাবলা গ্রাম অনেকটা দূরে। পথঘাট জানা নেই। শুধু জানি বরকতের ভাইয়ের ছেলে আইনউদ্দিন ওখানে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে গিয়ে পৌঁছলাম বাবলা গ্রামে।’ গত বছরের ওই দিনের অভিজ্ঞতা বলছিলেন রোকেয়া প্রাচী।
বাবলার পথে
রাস্তার দুই পাশের মাটির রং লাল। আর চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। জানা গেল, আলু চাষ খুব ভালো হয় এ গ্রামে। দূরে দিগন্তরেখার কাছাকাছি সবুজের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে বাড়িঘর। মাটির ঘরের পাশাপাশি মাথা বের করে আছে পাকা দালান। সামনে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। প্রথম দেখাতেই বলে দেওয়া যায়, এ গ্রামের মানুষজন মোটামুটি অবস্থাপন্ন। খানিক দূরে এগোতেই সামনে বিশাল প্যান্ডেল। ছয় দিনব্যাপী বরকত উত্সব নিয়ে ব্যস্ত গোটা বাবলা গ্রাম। কাউকে পথ চিনিয়ে দিতে হয় না। অনুমানের ওপর ভর করেই দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায় বরকতের বাড়ির সামনে। পুরোনো আমলের একটা দোতলা ইটের বাড়ি। বোঝা যায়, এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে বাড়িটি। এখন বরকতের পরিবারের কেউ অবশ্য থাকেন না এখানে। বরকত শহীদ হওয়ার পর সম্পত্তি বিনিময় করে তাদের পরিবার চলে আসে ঢাকার গাজীপুরে। বাইরের অতিথি দেখে একে একে আসতে থাকে বরকত উত্সবের আয়োজক কমিটির মানুষজন। এর মধ্যে চলে আসেন আইনউদ্দিনও। কথা হয় বরকতের আরও কয়েকজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। এরপর গেলেন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হলো। মুর্শিদাবাদ থেকে আবার বাবলা। তখন বাড়িঘর, স্কুল সবকিছুর চিত্রধারন করলেন। আত্মীয়স্বজনের সাক্ষাতকার নিলেন।
বরকত ভবন
বরকত ভবনকে ঘিরে মূলত আয়োজন হয় ছয় দিনের বরকত উত্সবের। গ্রামে আছে বরকতের নামে একটি স্কুলও। ঠিক বাংলাদেশের মতোই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে। মশাল মিছিল আর শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সূচনা হয় উত্সবের। তারপর পতাকা উত্তোলন। বরকত ভবনের পাশেই এক স্তম্ভের একটি শহীদ মিনার। এর পাশেই সব ভাষাশহীদের জন্য আলাদা আরেকটি শহীদ মিনার। প্রথমে ফুল দেওয়া হয় তাদের আপন গাঁয়ের ছেলে বরকতের শহীদ মিনারে। তারপর ঘুরে আবার ফুল দেওয়া হয় সব ভাষাশহীদের জন্য তৈরি শহীদ মিনারে। ছয় দিন ধরেই চলতে থাকে পুষ্পস্তবক অর্পণ। বরকত উত্সবের অন্যতম আকর্ষণ বরকত মেলা। আশপাশের বেশ কয়েক গ্রাম থেকে মানুষ আসে এই বরকত মেলায় যোগ দিতে। ছয় দিন ধরে পুরো গ্রাম ব্যস্ত থাকে এ আয়োজন নিয়ে। থাকে সংগীতানুষ্ঠান ও কবিতা পাঠের আসর। কলকাতা থেকেও আসেন গুণী মানুষজন। আসেন মন্ত্রী আর সরকারি কর্মকর্তারাও। মোটামুটি এলাহি কাণ্ড। সকালবেলা হাজির হয় স্কুলের ৩০০-৪০০ পড়ুয়া ।
বরকতের জন্য আলাদা করে স্তম্ভ নির্মাণটা তাঁদের ভালোবাসা আর আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। বরকতকে স্মরণ করার এ মেলায় পুরো আয়োজনই হয় গ্রামবাসীর নিজেদের আগ্রহে।
সেদিন বরকত ভবনের সামনে অবিস্মরণীয় এক দৃশ্য। ঠিক বাংলাদেশের মতোই দলে দলে মানুষ আসছে বরকত ভবনের সামনের শহীদ মিনারে। একই রকম মিলনমেলা। বুঝতে কষ্ট হয়না, তারাও বাংলা ভাষার চেতনাকে দরকারি মনে করে। সামনে ব্যানার নিয়ে এল স্থানীয় শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের একটি দল। তাদের ব্যানারে বড় করে লেখা—আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি…। কণ্ঠে ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ ধ্বনি। বাচ্চারা সবাই জড়ো হলো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে।
‘একটু পর অবাক করে দিয়ে বেজে উঠল আমাদের চিরচেনা সেই গান, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি। আমি তাজ্জব হয়ে সব শুনছি। আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষার জন্য এক বুক মমতা নিয়ে প্রতিবছর এভাবেই বরকতকে স্মরণ করে যাচ্ছে আরেক দেশের বাবলা নামের এক গ্রামের মানুষ। ভাবতেই কেন জানি জলে ভরে এল চোখ..।’ বলতে বলতে একটু বিরতি নেন রোকেয়া প্রাচী। বেশ বোঝা যায়, বাবলা গ্রামের সেদিনকার দৃশ্য এখনো লেগে আছে তাঁর চোখে আর অন্তরে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১০
Leave a Reply