৫৮টি চিত্র নিয়ে ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে চলছে রোকেয়া সুলতানার একক চিত্রপ্রদর্শনী। মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে মিশ্র ও টেম্পেরা।
রোকেয়া সুলতানার ছবির প্রধান আকর্ষণ রঙের মাধুর্য। একটির ওপর আরেকটি পাতলা রঙের স্তরে নির্মিত তাঁর ছবি। প্রতিটি রংই উজ্জ্বল ও সজীব। মনে হয় রং এখনো আর্দ্র। ক্যানভাস শুকিয়ে যাওয়ার পরও রঙের এই টলটলে ও আর্দ্রতা প্রাণসঞ্চার করেছে তাঁর ছবিতে। অধিকাংশ ছবির পটভূমি এভাবে রচিত হয়েছে। নিরীক্ষার এই প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে তাঁর ছবির পরবর্তী স্তর দর্শকের সামনে উন্মোচিত হয়। এই স্তরে শিল্পী সাযুজ্য রচনা করেছেন পটভূমির সঙ্গে বিষয়-ভাবনার। বিষয় হিসেবে এসেছে মাটি, পানি, বাতাস, বোধিসত্ত, নারীর শরীর-মুখমণ্ডল, উদ্ভিদ, ফুল, সাপসহ বিভিন্ন জৈব আকৃতি। বস্তুত, এ দুুটি স্তর বিচ্ছিন্ন নয়, পরস্পর বিজড়িত, যা ছবির বহুমাত্রিক স্তরকে একটি অখণ্ড সত্তা হিসেবে দর্শকের সামনে তুলে ধরে। ‘ভূমি, পানি, বাতাস’ শিরোনামের ছবিগুলোতে সবুজ, নীল, হলুদ প্রভৃতি রংকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকৃতির তিনটি উপাদানকে মিশ্রিত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকাশভঙ্গি বিমূর্ত হলেও রঙের তারল্য গতিশীল করেছে ফর্মকে।
‘লাভ’, ‘মুন লাইট’, ‘ইউ অ্যান্ড মি’ প্রভৃতি ছবিতে দুটি সত্তার মধ্যে সৌহার্দ্য বা অন্তরঙ্গতা, স্নেহ প্রেম বা ভালোবাসার অনুভূতিকে প্রকাশ করে। আবার ‘অ্যান আই ফর বুদ্ধা’, ‘বেধিসত্ত’ প্রভৃতি ছবিতে ধ্যানী, ত্যাগী বুদ্ধের সঙ্গে শিল্পীর নিজের অস্তিত্বের সংযুক্তি আধ্যাত্মিকতার তানুসন্ধানকে ইঙ্গিত করে। প্রদর্শনীতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রমালা ‘সুইমিং ইন দি অ্যাকুয়ারিয়াম’। ‘ভূমি, পানি, বাতাস’ সিরিজের বিস্তৃত ক্ষেত্রকে ধরার বিপরীতে সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে নিজেকে আবিষ্কার করার বা নিজের অস্তিত্বকে পুনরাবিষ্কৃত করার প্রচেষ্টা হতে পারে এই ছবিগুলো। পরিশেষে ‘দ্য মিস্টিক এম্পায়ার’ সিরিজের ছবিগুলো যেন আরেকটি জগেক উন্মোচিত করে, যে জগতে শিল্পীর আত্মজিজ্ঞাসা আরও প্রবল হয় ভ্রূণসদৃশ নারী-শরীর উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে, যা অস্তিত্বের প্রাথমিক অবস্থা বা শুরুকে নির্দেশ করে।
নিজ অস্তিত্বকে সমধর্মী কোনো কিছুর সঙ্গে অভিন্ন করে দেখা, যেখানে প্রেমের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে বা ভিন্নধর্মী কোনো কিছুর সঙ্গে অভিন্ন করে দেখা, যেমন ভালোবাসা এবং ত্যাগের সম্মিলিত প্রকাশ অথবা জন্মরহস্যের মাঝে অস্তিত্বের অনুসন্ধান—এসব বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে রোকেয়া সুলতানার কাজে। সামগ্রিকভাবে তাঁর এই চিত্রমালাকে আত্ম-অনুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়া বলা যায়, যা চিত্র সম্পাদনের ক্ষেত্রে ক্যানভাসে রং ও ফর্মের বহুমাত্রিক স্তর ও বিষয়ের দিক দিয়ে বহুমাত্রিক ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছে। মিশ্র মাধ্যম ও টেম্পেরায় করা রং দিয়ে তৈরি ফর্মগুলো অস্বচ্ছ নয় এবং স্বচ্ছ বলেও মনে হয় না। তা অর্জন করেছে আলোক-ভেদ্য গুণ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোকেয়া সুলতানার এই আত্ম-অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া হয়তো আরও নতুন বিষয় এবং প্রকাশভঙ্গির জন্ম দেবে।
প্রদর্শনী চলবে ২ মার্চ পর্যন্ত।
মাসুদা খাতুন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১০
Leave a Reply