জীবনে চলতে-ফিরতে যেসব আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, পাঠকের উকিল বিভাগে ১৫ দিন পরপর তারই সমাধান পাওয়া যাবে।পাঠকের উকিল বিভাগে আইনি সমস্যার সমাধান দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট নাহিদ মাহতাব। স্পষ্ট করে নিজের সমস্যাটি লিখে পাঠান। প্রয়োজনীয় কাগজের অনুলিপি দিন।
খামের ওপর লিখুন :
পাঠকের উকিল, নকশা, দৈনিক প্রথম আলো
সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুলইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
আমার ভাই তাঁর বিয়ের আগেই ডিভি ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। ভাই দেশে এলে আমরা পারিবারিকভাবে তাঁকে বিয়ে করাই। বিয়ের কিছুদিন পর আমার ভাই স্ত্রীকে দেশে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। বছরখানেক পর আমরা শুনি, ভাই গোপনে ঢাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করে ওই স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন। আমরা শোনার পর পারিবারিকভাবে সবাই ভাইকে চাপ দিচ্ছি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাদ দেওয়ার এবং প্রথম স্ত্রীকে দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন ভাই বলছেন, প্রথম স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। আমার প্রশ্ন, আইনত একজনের দুই স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া যাবে? আমার ভাই তাঁর প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ও নাগরিকত্ব পাওয়ার বৈধতা কতটুকু? ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তবে নাগরিকত্ব পাননি। আমার ভাই তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাদ দিলে তিনি কি আইনি সমস্যায় পড়বেন? আমার ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী কি ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীর বিরুদ্ধে বা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলে তিনি কি তাঁর স্বামীর কাছে আমেরিকা যেতে পারবেন?
তানিয়া খান
কুমিল্লা।
দ্বিতীয় স্ত্রী থাকাকালে প্রথম স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা আছে। তবে প্রথম স্ত্রী দাম্পত্যসম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও খোরপোষের মামলা করতে পারেন। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে এক বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন।
আমার ছোট ভাই স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। প্রায় দুই বছর হলো সে সিঙ্গাপুরে আছে। সিঙ্গাপুর যাওয়ার দুই মাস পর আমরা জানতে পারি, সে দেশে থাকতে একটি মেয়েকে পছন্দ করত। তখন থেকে আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে অন্য পথে যায়। ফোন করে অন্য একজনের কাছে। দুজন লোক মেয়েটিকে পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। বিনিময়ে তারা টাকা নিচ্ছে আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে। এখন সমস্যা হচ্ছে, সে বাড়িতে ফোন করে উল্টাপাল্টা কথা বলে। মেয়েকে ফোনে বিয়ে করতে চায়। আরও বলে, এই মেয়েকে না পেলে কোনো টাকাও দেবে না, মরে যাওয়ার ভয়ও দেখাচ্ছে। আমার আরেকটি ছোট ভাই ও ভাতিজা রয়েছে সিঙ্গাপুরে। তারা বলছে, ওকে দেখে ভারসাম্যহীন মনে হচ্ছে। ওর পছন্দের মেয়েটি নিতান্ত গরিব ঘরের। সে একসময় আমাদের বাসায় কাজ করত। এখন সে ঢাকায় একটি বাসায় কাজ করে। তাকে দুটি মোবাইল ফোনসেটও কিনে দিয়েছে আমার ছোট ভাই। একটি মেয়ের মা, অন্যটি মেয়ে ব্যবহার করে। মেয়েটি দেখতে ভালো নয়। তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সবার ধারণাও ভালো না। মেয়েটির বাবা অনেক আগেই ওদের ফেলে চলে গেছে। এসব কারণে এ সম্পর্ক মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়েটির সঙ্গে আমার ছোট ভাইয়ের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। কারণ, সে বিদেশ যাওয়ার সময় মেয়েটির বয়স কম ছিল। দুই মাস পর ভাই দেশে ফিরবে। আমার বাবা একজন সহজ-সরল মানুষ। তিনি বলছেন, এই মেয়েকে বিয়ে করলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। এ সমস্যা থেকে মুক্তির পথ আছে কি?
ইসহাক
আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
আপনার ভাই পরিবারের কথা চিন্তা না করে স্বার্থপরের মতো আচরণ করছেন। প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আপনার ভাই যদি মেয়েটিকে বিয়ে করেন, তবে সেই বিয়ে আইনগতভাবে প্রতিহত করার কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতাই সমাধানের পথ। আপনারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উপদেশের মাধ্যমে সমস্যাটির নিষ্পত্তি করতে পারেন। পারিবারিক অঙ্গীকার ও দায়িত্ব পালনে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পারিবারিক সম্পর্কের ভবিষ্যত্ পরিণতি সম্পর্কে আপনারা ভাইকে সচেতন করার চেষ্টা করতে পারেন।
আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমাদের জমি ক্রয়-বিক্রয়ে সরকারের কোনো অনুমতি লাগে না। আমার বাবার দাদার নামে ১৯৬২ সালে ২৬ বিঘা জমি রেকর্ড করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে আমাদের পরিবার ভারত চলে যায়। যুদ্ধ চলাকালে বাবার দাদা মারা যান। জমির ওয়ারিশ বলতে আমার বাবা ‘ক’ এবং বাবার ভাই ‘খ’ বেঁচে আছেন। আমার বাবার ভাই ‘খ’ ভারতে থেকে যান আর বাবা স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৭২ সালে আমার বাবার নামে ১৮ বিঘা জমি রেকর্ড করা হয়। বাকি আট বিঘা জমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে অন্য এক ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে দেন। উল্লেখ্য, ভারতবাসী বাবার ভাইরের নামে জমি রেকর্ড হয়নি। কিন্তু ‘খ’ নামের ভারতবাসী ভাই ১৯৮০-৮১ সালে বাংলাদেশে এসে ১৮ বিঘার মধ্যে নয় বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। বাবার নামে জমি ১৯৭২ সালে রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পরও কি জমির ওয়ারিশ ‘খ’ নামের ব্যক্তির জমি বিক্রি আইনে বৈধ? নাকি আমার বাবা ১৮ বিঘা জমির ১৯৭২ সালের রেকর্ডমতে মালিক? বাকি আট বিঘা যে অন্য মুসলিম নামে ১৯৭২ সালে রেকর্ড হলো, এর কী ব্যবস্থা নিতে পারি?
মিলন কুমার রায়
গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৬২ সালে আপনার বাবার দাদার নামে ২৬ বিঘা জমি রেকর্ডভুক্ত ছিল এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে আপনার বাবার নামে ১৮ বিঘা জমি রেকর্ডভুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আপনার বাবা ও তাঁর ভাই পরবর্তী রেকর্ড সংশোধনের মামলা করতে পারেন। আপনার বাবার ভাই আপনার বাবার নামে রেকর্ডকৃত জমি বৈধভাবে বিক্রি করতে পারেন না। রেকর্ড সংশোধন করে আপনার বাবার ভাই তাঁর প্রাপ্য অংশ নামজারি ও রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারেন।
আমার বয়স ১৬। আমরা দুই ভাই এক বোন। আমার বাবা দুটি বিয়ে করেছেন। আমার মা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। আমি আমার মায়ের প্রথম সন্তান। আমার মায়ের কাছে শোনা—আমার জন্মের পর আমার বাবা তাঁর সব সম্পত্তি প্রথম স্ত্রীর নামে হেবা দলিল করে দিয়েছেন। এখন আমার বাবার নামে কোনো সম্পত্তি নেই। আমার বাবাকে মা আমাদের সম্পত্তির কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করো না। আমার কাছ থেকে খাওয়া-পরা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।’ আমরা কি বাবার কোনো সম্পত্তিই পাব না? বাবার মৃত্যুর পর কি কোনো সম্পত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে? বা আমার জন্মের পর যে হেবা দলিল করা হয়েছে, তার কি কোনো মূল্য থাকবে আমার বাবার মৃত্যুর পর?
প্রিন্স
মতিঝিল, ঢাকা
সাধারণত হেবা দলিলের মাধ্যমে কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করা হলে সেই সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হিসেবে কারও অধিকার থাকে না। আপনার বাবার হেবা দলিলটি রেজিস্ট্রি করা থাকলে ওই দলিলবলে আপনার বাবার প্রথম স্ত্রী সম্পূর্ণ সম্পত্তির মালিক এবং আপনারা সেই সম্পত্তির কোনো অংশ পাবেন না। আপনার বাবার মৃত্যুর পর এ ধরনের দলিল বাতিলের কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমি বাবার একমাত্র মেয়ে। আমার বাবার আরও চারটি ছোট ভাই আছেন। তাঁদের প্রত্যেকের ঘরে ছেলে ও মেয়ে আছে। এখন অনেকে বলে, আমার বাবার সম্পত্তি নাকি আমি একা পাব না, আমার বাবার অন্য ভাইয়েরাও পাবেন। এ অবস্থায় আমার বাবার কি কিছু করার আছে? যা করলে সব সম্পত্তি আমি পাব। অথবা কোনো কিছু করার না থাকলে আমাদের সম্পত্তি কীভাবে বণ্টন হবে?
খালেদা আক্তার
রংপুর
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনার বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র মেয়ে হিসেবে আপনি আপনার বাবার পুরো সম্পত্তির অর্ধেক অংশের হকদার। বাকি অর্ধেক সম্পত্তি আপনার বাবার ভাইদের মধ্যে নির্দিষ্ট অংশে বণ্টিত হবে। তবে আপনার বাবা যদি পুরো সম্পত্তি আপনার নামে হস্তান্তর করতে চান সে ক্ষেত্রে জীবদ্দশায় তিনি আপনার নামে হেবা দলিল সম্পাদন করতে পারেন। এই দলিলটি অবশ্যই রেজিস্ট্রি হতে হবে।
চার বছর ধরে আমার একজন সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার সহকর্মী হিন্দু। এই সম্পর্কের মধ্যে তিন বছর আগেই ও আর আমি হিন্দুধর্মমতে বিয়ে করি। আমি নিজেকে ওর স্ত্রী বলে দাবি করি। শাঁখা ও সিঁদুর পরিধান করি। তবে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করিনি। ও নিজেও করেনি। এ সময়ে আমরা দুজন একত্রে এক বাসায় অবস্থান করছি।
এখন আমার বাসায় আমার বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে। আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমাদের বিয়ে কি আইনগত বৈধ? যদি না হয় তবে নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে আমরা কীভাবে স্বামী-স্ত্রীর মতো আইনত বসবাস করতে পারি? আমি কি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে ওকে বিয়ে করতে পারি? আমার বাড়িতে খুব তাড়াতাড়ি আমার বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে।
জিসা
ঢাকা
হিন্দুধর্মে কনভারসন বা ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো মুসলমান কিতাবি ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে। এ ধরনের বিবাহকে অনিয়মিত বিবাহ বলা হয়। তবে অনিয়মিত ও বাতিল (ভয়েড) বিবাহের মধ্যে পার্থক্য হলো, অনিয়মিত বিয়ে নিয়মিত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আপনার স্বামী মুসলিম ধর্মে ধমান্তরিত হয়ে বিয়েকে নিয়মিত বা বৈধ করতে পারেন। নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখলে পরে উত্তরাধিকার আইনে আপনাদের সমস্যা হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply