ভাষা, বহতা নদীর মত। ভাষার নামে যে দেশের নাম সেই ভাষার আকুতি হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে ফেলছি আমরা আমাদের স্বকীয়তাকে। তাই নতুন প্রজন্ম আজ বিভ্রান্ত। সচেতনতা আর দেশপ্রেমই পারে এ সংকট মোকাবেলা করতে। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠবে মাতৃভাষার বর্ণমালায়। এটাই আমাদের একুশের উজ্জ্বীবিত আহ্বান। শিশুদের মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থাও উত্তোরনের পথ নিয়েই আমাদের এই প্রতিবেদন।
শুক্রবার। ছুটির দিনে মেয়ে টুম্পাকে একটু বেশিই সময় দিতে পছন্দ করেন শাওন্তী রহমান। টুম্পার সাথে টেলিভিশন দেখতে বসেছেন শাওন্তী। রিমোটের বোতামে চ্যানেল বদলাতে বদলাতে চোখ থমকে গেল টিভি পর্দায়। অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গীতে হাত-পা নেড়ে একজন তরুণী ‘ভিউয়ার্স’ বলতে বলতে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’, ‘আপনাদের ফেভারিট প্রোগ্রাম ওয়াচ-এর আমন্ত্রণ জানালো। তরুণীর মুখে এই রকমের বাংলিশ (বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ) ভাষা শুনে শাওন্তীর আট বছরের মেয়ে টুম্পা বলল, ‘আম্মু আন্টি কি বাংলা বলছে, না কি ইংরেজি?’ মেয়ের কথা শুনে শাওন্তী কী বলবেন খুঁজে পেলেন না। তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘বাংলার মত এমন একটি মধুর ভাষা থাকতে এরা কেন এমন হাস্যকর একটা ভাষায় কথা বলছে? ইংরেজি ভাষায়ও কি শব্দের অভাব পড়ে গেল? তার মেয়ে চারপাশের এসব দেখে কী শিখবে? শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারবে কি? ভাবনাগুলো এখন আর শাওন্তীর একার নয়। বর্তমানে আমাদের অনেকের মনেই এই প্রশ্নগুলো দোলা দিয়ে যায়। আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভালোবাসা আর কষ্ট নিয়ে আমাদের দেশের নাম হয়েছে ভাষার নামে। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি। বাংলা মায়ের বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে প্রাণদানের এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বায়ান্নর সেই আগুন ঝরা আন্দোলনই রচনা করে দিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের পথরেখা। আজও আমরা আমাদের রক্তে শুনি সেই দিনের মন্ত্রণা। এ কারণেই ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের দায়িত্ববোধকে উদ্বুদ্ধ করে। শুধুমাত্র বাঙালির প্রাণেই নয়, মাতৃভাষার মর্যাদা আর গুরুত্ব এখন ছড়িয়ে গেছে পৃথিবী জুড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
কিন্তু এ আন্তর্জাতিক অর্জনের পরও যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তা হল, এত বছর পরও আমরা কি পেয়েছি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই বর্ণমালার শুদ্ধ ব্যবহার শিখতে? ছেলেমেয়েদের কাছে বর্ণমালাকে পৌঁছে দিতে? ভাষার নামে যে দেশের নাম, সেই দেশের ভাষা চর্চার মানটা কেমন? বর্তমান সময়ে পথ চলতে, নাটক-সিনেমা দেখতে, এমন কি কারও সাথে কথা বলতে গেলেও রীতিমত অবাক হতে হয়। অর্ধেক বাংলা আর অর্ধেক ইংরেজি মিলে মিশে এক শংঙ্কর ভাষার উদ্ভব হয়েছে আমাদের দেশে। দুঃখজনক হলেও সত্য এই হাস্যকর ভাষার ব্যবহার আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, বাংলা শিক্ষার অনীহা, দায়িত্ববোধের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা ভাষা দিন দিন হারাচ্ছে তার শুদ্ধতা ও মাধুর্যতা। এতে করে বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাকেই অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা আবশ্যক। মাতৃভাষা বাংলা শেখার যেমন দরকার তেমনি ভাবে বিংশ শতাব্দীর দুয়ারে এসে অস্বীকার করা যাচ্ছে না ইংরেজিকেও।
অতএব, সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে প্রাথমিক স্তর থেকে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার শিক্ষা দেওয়া। আর এ ক্ষেত্রে মাতৃভাষা যদি হয় মাধ্যম তবে তো সোনায় সোহাগা। বিশ্ব সাহিত্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে মাতৃভাষা বাংলার বিকল্প নেই।
নিজের পরিচয় জানাতে অবশ্যই চর্চা দরকার বাংলা ভাষার। গৌরবময় সেই ভাষাকে জানাতে প্রয়োজন আত্মচেতনা ও সরকারি উদ্যোগের। এ বিষয়ে কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘শিশুদের শুদ্ধভাষা শিক্ষার জন্য প্রয়োজন আত্মচেতনা, সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা। প্রয়োজন দরদী ও উপযুক্ত শিক্ষকের যারা শিশুদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। সর্বোপরি, সবার উপরে কাজ করবে সকলের দেশপ্রেম।’
যাদের মাতৃভাষার শিক্ষার মান যত ভাল তারাই খুব সহজে আয়ত্ত করতে পারে যে কোন ভাষা। তাই এখন থেকেই প্রয়োজন ভাষা চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা। শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই নয়, সারা বছরেই ভাষা প্রেম জাগ্রত হোক সবার মাঝে।
ছবি সৌজন্যে স্কলাস্টিকা স্কুল
(জুনিয়র সেকশন)
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০১০
Leave a Reply