একটি রোগ আছে যে রোগটির সৃষ্টি ও বিস্তার উভয়ই ঘটে মনের ভিতর অর্থাৎ এটি একটি মানসিক রোগ। এ রোগটিকে নীরব ঘাতক বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কারণ রোগটির মাত্রা একজন ব্যক্তির ভেতর যখন খুব বেশি পরিমাণে দেখা দেয় তখন তা ধ্বংস করে দিতে পারে ব্যক্তি এবং তার চারপাশের সম্পর্ককে। রোগটির নাম ‘সন্দেহ’। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছেন এরকম মানুষ খুঁজতে গেলে কিন্তু কম পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের এবারের মন মন্দিরে উঠে এসেছে মানসিক এ রোগটিকে নিয়ে নানা কথা। লিখেছেন সামিয়া আসাদী
দাম্পত্যে সন্দেহ
ঘটনা-১ ঃ লুনা আর শফিক বিয়ে করেছেন প্রায় দেড় বছর। ভালই কাটছিল দু’জনের ছোট্ট সংসার। সেই সংসারে একদিন সন্দেহের রোগ দানা বাঁধল। লুনা শফিককে এবং শফিকের এক সহকর্মীকে নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে। সেই সন্দেহ আস্তে আস্তে ডালপালা গজিয়ে এমন রূপ ধারণ করে যে লুনা-শফিকের বৈবাহিক সম্পর্কটাই শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকে না।
ঘটনা- ২ ঃ তানভীর-টিনা দু’জন স্বামী স্ত্রী। দু’জনের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাঁধে প্রায়ই। বিষয়টি হলো- তানভীর মনে করে টিনা তার বাবার বাড়িতে তানভীরকে না জানিয়ে টাকা-পয়সা পাঠায়। অন্যদিকে টিনা মনে করছে তারভীর টাকা-পয়সার ব্যাপারগুলো প্রায়ই তার কাছে লুকায়।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম অনেক বিষয় নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়, যেগুলোর হয়তো তেমন বাস্তব প্রমাণ নেই। অনেক সময় এ সন্দেহের মাত্রা এতো বেড়ে যায় যে তা শুধু দাম্পত্য-জীবনকে তিক্ত করে তা নয় এমনকি এ সন্দেহের কালো ছায়ায় ধ্বংস ও হয়ে যায় অনেক সুখের সংসার।
সন্তানের প্রতি সন্দেহ
প্রতিটি বাবা-মাই তার সন্তানকে ভালোবাসেন, সন্তানের ভাল চান। কিন্তু এ ভাল চাইতে গিয়ে অনেক সময়ই সন্তানদের উপর অহেতুক সন্দেহ করে বসেন তারা যার ফলে হীতে বিপরীত ঘটে। যেমন- বাবার হয়তো সন্দেহ হলো ছেলে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ছেলেকে হয়তো এ করণে গাল মন্দ করলেন। ব্যাস ছেলেও বাবার উপর জিদ করে সিগারেট খাওয়া শুরু করে দিল। ফলে অহেতুক সন্দেহ থেকে বিপত্তি ঘটতে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগে না।
বাবা-মার প্রতি সন্দেহ
প্রায়ই সন্তানরা বাবা-মার প্রতি অভিযোগ করে বলে যে, বাবা-মা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটি ইচ্ছে করে কিনে দিচ্ছে না, কিংবা ছোট ভাই-বোনকে বেশি আদর করে, বন্ধুর বাসায় যেতে দেয় না ইত্যাদি। এসব অভিযোগের মূলে যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো বাবা-মার প্রতি সন্তানদের এক ধরনের সন্দেহ। এ সন্দেহ গুলোই তাদের এসব চিন্তা করতে প্রভাবিত করে।
বন্ধুদের মধ্যে সন্দেহ
হয়তো সাত-আট জনের একটা গ্রুপ, এরা খুব ভাল বন্ধু, একসাথে পড়াশোনা করে, নোট তৈরি করে। হঠাৎ করে এদের মধ্যে কারো মনে হল তাকে গ্রুপের আসল নোট দেয়া হচ্ছে না। ফলে সে অন্য বন্ধুদের সন্দেহ করতে শুরু করে। আর এ সন্দেহের কারণেই হয়তো ভাঙন ধরলো দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে।
কর্মক্ষেত্রে সন্দেহ
অনেক সময়ই আমরা নিজেদের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকার কারণে কর্মক্ষেত্রেও সন্দেহ প্রকাশ করি। ফলে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আমরা প্রায়ই মনে করি অফিস কর্তৃপক্ষ আমাদের যথাযথ মূল্যায়ন করছে না বা অন্য কেউ কম কাজ করে বেশি সুবিধা পাচ্ছে।
কেন এই সন্দেহ
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্দেহের কারণ এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হলেও সাধারণতঃদেখা যায় যে বেশিরভাগ সন্দেহের পেছনেই নিরাপত্তাহীনতা এবং পারিবারিক আবহ কাজ করে। অনেক ব্যক্তি আছেন যারা মনে করেন কেউ তার ভাল চাচ্ছে না। অর্থাৎ সবাই তার শত্রু এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় সন্দেহ বাতিকতা। এছাড়া যেসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বহির্জগতের সাথে যোগাযোগ কম থাকে এবং যাদের পরিচিতির গন্ডি সীমাবদ্ধ থাকে তাদের মধ্যে সন্দেহের প্রবণতা বেশি থাকে।
সন্দেহ থেকে মুক্তির উপায়
০ সন্দেহ যেহেতু সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার তাই সন্দেহ দূর করার প্রধান ঔষধ হচ্ছে ‘মানসিক জোড়’ বাড়ানো। এক্ষেত্রে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্রই মানসিক জোড়টাকে কাজে লাগাতে হবে।
০ কথায় আছে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। তাই বিশ্বাসের ভিত্তিটা শক্ত হলে সন্দেহের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না।
০ নিজেকে সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে আপনার চার-পাশের পরিবেশ, এবং মানুষ মানুষের আচরণ সম্পর্কে জানুন। এতে করে চিন্তা-ভাবনা প্রসারিত হবে এবং কারণে-অকারণে সন্দেহ করার অবকাশ থাকবে না।
০ কোনো বিষয় নিয়ে সন্দেহের অবতারণা হলে ভেতরে ভেতরে তা চেনে না রেখে যাকে নিয়ে সন্দেহ তার সাথে এ বিষয় নিয়ে খোলা-মেলা আলোচনা করুন। অর্থাৎ সন্দেহটাকে বাড়তে দেবেন না।
০ সন্দেহ করার মতো সত্যি কোনো ঘটনা ঘটলে ধৈর্য্য সহকারে মাথা ঠান্ডা রেখে বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। উত্তেজিত হয়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবেন না।
০ আপনার যদি মনে হয় সন্দেহ করার প্রবণতাটি আপনার মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় দেখা দিচ্ছে তাহলে মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০১০
rajib
thats right