সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে সানা। ইংরেজি মাধ্যম। স্কুলে সারা দিন এ-বি-সি-ডির মধ্য দিয়েই চলে যায়। বাসায় মা-বাবাও এখন তার সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলেন। ভাবেন, তাতে ইংরেজিচর্চার মজবুত ভিত তৈরি হবে। তাহলে ও বাংলায় কথা বলবে কখন?
শহরে এখন অনেক ছেলেমেয়েই পড়াশোনা করছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। ফলে স্কুলে বেশির ভাগ সময়ই ইংরেজি পড়তে হচ্ছে, ক্লাসে ইংরেজিতে কথা বলতে হচ্ছে। বাংলার ক্লাসটা ছাড়া স্কুলে অন্য বিষয়গুলোর ক্লাসগুলোও চলছে ইংরেজিতে। এরপর বাড়ি ফেরা।
ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটির সঙ্গে বাসাতেও ইংরেজিতে কথা বলেন যাঁরা, তাদের মনে হয় এভাবে ইংরেজিতে আরও দক্ষ হয়ে উঠবে ছেলে বা মেয়েটি, ভবিষ্যতের বৈতরণী পার হবে তরতর করে। আলাদা করে অনেক পরিবারেই জোর দেওয়া হয় ইংরেজি বলতে, শিখতে এবং যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও ব্যবহার করতে। কিন্তু এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাটা হারিয়ে যায় শিশুটির জগত্ থেকে। মাতৃভাষার ভিতটা হয়ে পড়ে দুর্বল। মাতৃভাষা তো আর শুধু ভাষা নয়, এ আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি—এটাই শেকড়। তাই পড়াশোনা বা কাজের মাধ্যম যাই হোক না কেন—বাড়িতে বাংলা বলার চলটা থাকা জরুরি।
পরিবারে বাংলার চর্চা থাকতে হবে
তাহমিনা হক। পেশা শিক্ষকতা। ছেলেমেয়ে দুজনই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। ওরা তো ইংরেজিতে ভালো করছেই, তাই কখনো বাংলার ওপর গুরুত্ব দেননি তিনি। ফলে বাংলা ভাষায় দুর্বলতা তাদের রয়েই যায়।
ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ দিকটার কথা তুলে ধরেন, ‘পরিবার থেকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাচ্চারা। অভিভাবকেরা বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করার পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন না যথাযথভাবে। ইংরেজি ভাষা শিখতে এবং বলতে পারাকে যোগ্যতা মনে করছেন, যেটা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে মনে করছেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কলেজে ইংরেজিতে পড়ে এসেছি। ইংরেজি তখন বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ, চাকরির বিষয়টি ছিল। কিন্তু বাড়িতে তখন বাংলার চর্চা ছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রচুর বই পড়া, বাংলায় কথা বলা চলত।’
স্কুল সময়ের বাইরেও অনেক বাড়িতেই ইংরেজি কথা বলা শেখানো হয় ভাষা ভালোমতো বোঝার আগে থেকেই। ‘এখানে এসো’ বলা হয় না, বরং বলা হয় ‘কাম হিয়ার’। শহুরে স্কুলে ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টারের’ ওপরই জোর বেশি থাকে। সেখানে ‘আমাদের ছোট নদী’ হারিয়ে যায় পথের বাঁকে। ‘ঠিকমতো খাও’ না বলে বলা হয় ‘ইট প্রপারলি’। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাতৃভাষাটা জানতে হবে ভালোভাবেই। নিজ ভাষা না জানলে ভিনদেশি একটি ভাষা আয়ত্ত করা মোটেও সহজ নয়।
কিছুদিন আগের কথা। ঢাকার সানিডেল স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী। স্কুলটির ছাত্রছাত্রীরা বাংলায় তাঁর সঙ্গে কথা বলে। প্রশ্নগুলোও ছিল বাংলায়। সানিডেল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ জানান, ‘বাংলা ভাষা আমাদের পরিচয়। এ ভাষা না জানলে আমরা পরিচয়হীনতায় ভুগব। দেশ, ভাষা, মা—এ তিনটি শব্দকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে।’
তাজিন আহমেদ বলেন, ‘ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখতেই আমাদের স্কুলে বাংলায় কবিতা পাঠ করানো হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখের পরিচয়, আলোচনা, এমনকি অনুষ্ঠানও করানো হয়। স্কুলগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এখানেই থেমে থাকলে হবে না। বাংলার পরিবেশ দরকার পরিবারেও।’
শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা উচিত। উচ্চারণ যেন শুদ্ধ হয় সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিলেন তাজিন আহমেদ। তিনি আরও যোগ করেন, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর পর্বটা বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বইমেলা, শহীদ মিনার, বধ্যভূমি প্রভৃতি জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। দরকার না থাকলে ইংরেজি বলার দরকার কী। যেমন, শসাকে কিউকামবার না বলে শসা বলাটাই ভালো। পড়ার বাইরে যতটা সম্ভব বাংলায় কথা বলা হোক—বললেন তিনি।
স্কুলে সারা দিনই ইংরেজির চর্চা চলছে। আবার বাড়িতেও অনেক সময় তা-ই। দ্বিমুখী এ চাপে বাচ্চাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন লেখক, সাংবাদিক আনিসুল হক। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে এটা অনেকটা শাঁখের করাতের মতো অবস্থা হয়। স্কুলে শেখানো হয় ইংরেজি। সেখানে কথা বলা এবং শেখার ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই জোর দেওয়া হয়। বাড়িতে আসার পর বিদেশি এ ভাষাটার প্রতি মমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলতেই থাকে। তিন সাড়ে তিন বছরের শিশুরা দুই দিকের এ চাপে বাংলার ওপর আয়ত্ত আর রাখতে পারে না।
আনন্দ নিকেতন ইউরোপিয়ান স্কুলের অধ্যক্ষ সামসি আরা হাসানের মতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বাংলা কবিতার বই, গান শোনা অনেকাংশে উপকার দেবে। ছোটবেলায় বাচ্চারা ছবি আঁকে। ছবি আঁকার পর জিজ্ঞেস করা হলো সে কী এঁকেছে। সেটা আবার সন্তানদের দিয়েই নিচে লিখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাসায় মাঝেমধ্যে সিডিতে বাংলা কবিতা, শিশুতোষ গান ছেড়ে রাখলে অবচেতন মনেই বাংলার প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। এ ছাড়া সংবাদপত্রে ছোটদের জন্য একটা বিভাগ প্রকাশ করা হয়। মায়েরা এ বিভাগ থেকে ছড়া, গল্প, কবিতা পড়ে শোনাতে পারেন।
তিনি বলেন, দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটি মাত্র ভাষা আমাদের। পরিবার থেকেই এর যত্ন নেওয়া শুরু হওয়া উচিত। শহীদদের প্রতি, বাংলার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কী হতে পারে। প্রতিটি পরিবারেই সারা বছর বিরাজ করুক বাংলার পরিবেশ।
ঘরোয়া পরিবেশে বাংলা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, যেসব সমাধান সামনে আসে, তার মধ্যে প্রথমেই হলো বাসা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা এক না করা। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
দেশে বাংলা মাধ্যমের মানসম্মত স্কুল আরও থাকা প্রয়োজন। ইংরেজি ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে এ কারণেই। টেলিভিশন, এফএম রেডিও, বিজ্ঞাপনে তৈরি হচ্ছে জগাখিচুড়ি ভাষা। বিকৃত হচ্ছে বাংলা ভাষা—মন্তব্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। এ বিষয়কে পরিহার করতে হবে।
আনিসুল হক বলেন, বাংলায় কথা বলা দরকার। বন্ধুবান্ধব অথবা মা-বাবার সঙ্গে ইংরেজি বলা বাদ দিয়ে বাংলায় কথা বলার অভ্যাস করা জরুরি। পাশাপাশি প্রচুর বাংলা বই এবং সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস করা উচিত। ভালো বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে হবে, বাংলা গান শুনতে হবে। এসবের মধ্য দিয়েই তৈরি করতে হবে বাংলা চর্চার পরিবেশ।
বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলায় কথা বলার চর্চা বেশি করে, বাংলা চ্যানেল খুব বেশি দেখে। এ কারণে বাংলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা বেশি।
ম্যাপললিফ স্কুলের নার্সারির শিক্ষিকা মুনিয়া আরেফিন। তিনি মনে করেন, নার্সারির বাচ্চারা এ, বি, সি শিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ক, খ, গ, ঘ তাদের কাছে একটু কঠিনই লাগে। এটি তাদের জন্য একটি বিশাল বাধা। বাসায় এ জন্য দরকার বাংলা চর্চার পরিবেশ। বছর শুরু হয় মাতৃভাষার সান্নিধ্যে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শিশুদের নিয়ে যাওয়া, বইমেলা থেকে বই কিনে দেওয়া, পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া দরকার এ বয়স থেকেই। এ ছাড়া বছরশেষে বিজয় দিবসের মর্ম বোঝাতে পারেন গল্পচ্ছলে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুনিয়ে। যেহেতু স্কুলে বিদেশি ভাষা শেখানো হয়, বাসায় দেশি ভাষা চর্চার পরিবেশ অবশ্যই দরকার—বললেন মুনিয়া।
‘মা জানো, আজকে আমার পাশে বসা ছেলেটি বলতে পারেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কী। কিন্তু আমি তো জানি।’ সারা দিনের স্কুুলের গল্প শোনাচ্ছিল মীর তাফহীম রাইয়ান। সানবিমসের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে সে। ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যমে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে দেননি মা রাফিয়া ইসলাম। বাংলা পত্রিকা পড়ানো, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলানো সবকিছুর তদারকিতেই আছেন তিনি।
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে দরকার ইংরেজি জানা। কিন্তু সুন্দর করে, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাটাও কিন্তু যোগ্যতা। নিজ ভাষা না জানলে একটা শূন্যতা সব সময়ই থেকে যাবে। তা সে যতই অন্য ভাষায় পারদর্শী হোক না কেন। এখানে ইংরেজি ভাষাকে ছোট করা হচ্ছে না।
বাদ দিতেও বলা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের ভাষাকে আপন করে নেওয়ার কথা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় কথা বলা, লেখার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করি না কেন নিজেদের। আর সে চেষ্টার শুরুটা হোক বাড়িতেই।
মডেল: ফারিহা শামস (সেওতি) ও আরানা
রয়া মুনতাসীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply