সমস্যা: যেহেতু বাবার প্রভাব কম, তাই মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছুই আমার মধ্যে আছে। তাই ভয় হয়, তাঁর মতো আমিও একই ভুলগুলো করব কি না। আমি প্রাণোচ্ছল, মিশুক হতে চাই, যাতে জীবনের বাকি সময়ে আমার আত্মমর্যাদাটুকু ফিরে পেতে পারি। ওষুধ বা কাউন্সেলিং, যা দরকার তা-ই আমি করব। আমি অনুভব করি, আমার সব সময় কোনো না কোনোভাবে অন্যের কাছ থেকে মানসিক সহানুভূতি ও পরামর্শ দরকার। কাউন্সেলিংয়ের জন্য আপনার ঠিকানা ও সময়সূচি যদি সম্ভব হয়, দয়া করে দিলে বাধিত হব। অথবা ভালো কোনো কাউন্সেলিং সেন্টারের ঠিকানা দিলে ভালো হয়। আর আমি জানতে চাই, কীভাবে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: তোমার মা কী কী ভুল করেছেন, সে সম্পর্কে তুমি কিছু লেখনি। চিঠি পড়ে বোঝা গেল তুমি প্রাণোচ্ছল, মিশুক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি হতে চাও। তবে আমাদের ব্যক্তিত্বের মূল জায়গাগুলো কিন্তু জীবনের প্রথম পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। এ সময়ের ভেতর আমরা আমাদের খুব কাছের মানুষের যা কিছু করতে দেখি, তার অনেক কিছুই নিজের অজান্তে অনুকরণ করার প্রবণতা তৈরি করে ফেলি। বড় হওয়ার পর দেখা যায়, অভিভাবকদের যে আচরণগুলো ছেলেবেলায় আমরা খুব অপছন্দ করেছিলাম, সেগুলোই আমাদের আচরণের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তখন খুব হতাশ লাগলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। তুমি নিজেই সচেতন হয়ে তোমার মানসিক অবস্থানটি চিহ্নিত করেছ, এটা খুবই উত্সাহব্যঞ্জক। প্রাথমিক পর্যায়ে তোমার এ উদ্যোগটি এখন চলার পথের পাথেয় হতে পারে। এ ছাড়া তুমি যে নিজে থেকেই কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে চেয়েছ, সেটা অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। তবে কাউন্সেলিংয়ে প্রচলিত অর্থে কোনো পরামর্শ দেওয়া হয় না। মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ে একটি মানুষকে তার নিজের ব্যক্তিত্ব বুঝে চিন্তা ও আবেগগুলোকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া কাউন্সেলিংয়ের সাহায্যে মানুষ তার সবল ও দুর্বল দিকগুলো বুঝে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম হয়। তুমি তোমার ইচ্ছেগুলোর বাস্তবায়ন চেয়েছ। তবে তোমাকে কিন্তু মেনে নিতে হবে যে আমরা আমাদের সব ইচ্ছেকে ঠিক একইভাবে পূরণ সক্ষম করা না-ও হতে পারি। তবে বাধাগুলো অতিক্রম করে খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়। সব সময় অন্যের সহানুভূতি বা পরামর্শ নিয়ে জীবনে চলা যায় না এবং তা ঠিকও নয়। আমরা নিজস্ব শক্তি, সাহস ও সহায়তা নিয়ে চলব—এই লক্ষ্য স্থির করেই আগামী দিনগুলোর চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি হতে হবে। আপাতত তুমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাইকোথেরাপি নিতে পার।
সমস্যা: আমি তানজীম (ছদ্মনাম), কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলি। এভাবে অনেক দিন অতিবাহিত হলো। একসময় আমি শুনতে পেলাম মেয়েটা বিবাহিত। এখন আমি তাকে ভুলতে পারছি না এবং কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। তাকে ভোলার জন্য আমি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছি। এ জন্য আমার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা খারাপ হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: তুমি লিখেছ মেয়েটিকে তোমার প্রথমে পছন্দ হয়, তারপর ভালোবেসে ফেলেছ। আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটি তোমার কলেজেই পড়ে কি না। তার সঙ্গে তোমার কোনো কথাবার্তা হয়েছে কি না, সেটাও পরিষ্কার নয়। তুমি তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলে কি না, তা-ও তোমার চিঠিতে কিছু লেখা নেই। তার বিয়ের খবরটা তুমি কার কাছ থেকে জেনেছ, সেটাও লেখনি। যেটুকু লিখেছ তাতে মনে হচ্ছে, তাকে তুমি দূর থেকেই পছন্দ করেছ। ভালো করে একজনকে না জেনে তাকে নিয়ে কল্পনাবিলাসী হলে পরে কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। প্রতিটি মানুষের চারিত্রিক অনেক দিক থাকে, যার সবগুলোই যে অন্য একজনের ভালো লাগবে—এমন কোনো কথা নেই। কারও সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই তার প্রেমে পড়ে গেলে সম্পর্কে অনেক টানাপোড়েন তৈরি হয়। মনের যুক্তির জায়গাটি যখন আবেগের জায়গা দিয়ে খুব বেশি প্রভাবিত হয়, তখন আমরা নিজের বিচার-বুদ্ধির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। তোমারও এখন যুক্তিগুলো মোটেও কাজ করছে না। মেয়েটি যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তোমাকে অবশ্যই নিজেকে বোঝাতে হবে, তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক করাটা কেন সম্ভব নয়। সততা ও আন্তরিকভাবে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করলে এ ধরনের কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। এ ছাড়া কাউকে ভোলার জন্য মাদকের সাহায্য নেওয়া মানে নিজের সত্তাকে এবং মনের শক্তিকে অপমান করা। এই সর্বনাশা আসক্তি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোমাকেই সবটুকু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চেষ্টা করতে হবে। মাদকাসক্তি আমাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো নিঃশেষ করে দেয়। তোমার এখন বয়ঃসন্ধি চলছে। এ সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে যেহেতু এখন লেখাপড়া করার সময়, তোমাকে এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানের দাবিগুলো মেটাতেই হবে। যদি সেটা ধীরে ধীরে সম্ভব করতে পার, তাহলে নিজেকে মনে মনে অনেক বাহবা দেবে, কেমন? আশা করি, তুমি তোমার মনের অবাধ্য জায়গাটিকে নিয়ন্ত্রণে এনে এ মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ লেখাপড়ায় মন দিতে পারবে। অনেক শুভ কামনা রইল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০৬, ২০১০
Leave a Reply