হৃদরোগ একটি মরণব্যাধি। এর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলছে। ক্রমেই বাড়ছে অকাল মৃত্যুর হার। হার্ট অ্যাটাকের কারণে কেউবা হঠাৎ মারা যান, আবার কেউ মারা যান দীর্ঘ যন্ত্রণাময় কষ্টে ভুগে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি, যা আস্তে আস্তে বাড়ছে।
কোনো কারণে হৃৎপিণ্ডের রক্তবাহী নালি সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক অথবা মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন হয়। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত প্রায় ৪০ ভাগ লোকই মৃত্যুবরণ করে। অ্যাটাকের এক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া কিংবা চিকিৎসা নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর যারা বেঁচে যায়, তারা সতর্ক না হলে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাকের জন্য বেশ কিছু কারণ দায়ী। এর মধ্যে কিছু কারণ অপরিবর্তনীয়। আর কিছু ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অপরিবর্তনীয় কারণগুলো হলো আগে হার্ট অ্যাটাক হওয়া, করোনারি হৃদরোগ, বয়স বাড়া, নিকটাত্মীয়ের হৃদরোগ প্রভৃতি। পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি মেয়েদের চেয়ে বেশি, তবে আক্রান্ত হলে নারীদের মৃত্যুঝুঁকি আরও বেশি। যেসব ঝুঁকিপূর্ণ কারণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং তাতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়, তা হলো ধূমপান বর্জন, সুনিয়ন্ত্রিত ওজন ও খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম করা, নিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, রক্তের কোলস্টেরল ও নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস (যদি থাকে)।
হার্ট অ্যাটাক কখন, কীভাবে হয় এটা বলা মুশকিল হলেও এর কয়েকটি সতর্কসংকেত রয়েছে। তবে ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে এটা অজান্তেও হতে পারে।
হৃদরোগ কমানোর জন্য বা প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আর এটা হার্ট অ্যাটাকের কম ঝুঁকিসীমা কিংবা বেশি ঝুঁকিসীমার মধ্যে চলাফেরাকারী সব লোকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যাদের একবার হৃদরোগ হয়েছে, তাদের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিসীমা নির্ণয় করা যায়, হার্ট অ্যাটাকের পরে সাবধান হবেন নাকি আগে থেকেই সাবধান হবেন-এ সিদ্ধান্ত আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন। বয়স ৪০ পেরোলেই শরীরের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
হৃদরোগের আগেই যদি ঝুঁকিসীমা নির্ণয় করা যায়, তাহলে বাঁচানো যায় জীবন। সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা ও ঝুঁকিসীমা নির্ণয়ের জন্য ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিয়াক সেন্টার এবং ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন ও আলট্রাসাউন্ড বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক গামা ক্যামেরা, সিস্টামিবি আইসোটোপ ও এডিনোসিন ওষুধের সাহায্যে অত্যাধুনিক পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করেছে। পরীক্ষাটির নাম এডিনোসিন স্টেস মায়োকার্ডিয়াল পারফিউশন ইমেজিং। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সেন্টারের তত্ত্বাবধানে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে এ পরীক্ষাটি করা হচ্ছে।
কাদের এ পরীক্ষা করা যাবে
বিএসএমএমইউর কার্ডিয়াক সেন্টারের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা· কে এম এইচ এস সিরাজুল হক জানিয়েছেন, যাঁদের বয়স ৪০ বা তার বেশি, যাঁরা ধূমপায়ী, যাঁরা দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন, যাঁদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, যাঁরা হাঁটুব্যথা, কোমরব্যথা, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক), অঙ্গহানির জন্য ইটিটি পরীক্ষা করতে সক্ষম নন, যাঁদের ইটিটির মাধ্যমে হৃদরোগের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না, তাঁদের এই পরীক্ষাটি করা যাবে। এ ছাড়া এই পরীক্ষার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের পর হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির সবলতা ও সক্ষমতা নির্ণয় করা যায়, যার মাধ্যমে পরবর্তী এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস সার্জারির পর আবার আপনার করোনারি আর্টারি ডিজিজ হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা যায়। অতিরিক্ত ওজন বা হাঁটুব্যথার জন্য যে নারীরা রোগী ইটিটি পরীক্ষা করতে সক্ষম নন, তাঁদের জন্য এই পরীক্ষাটি হৃদরোগের ঝুঁকিসীমা নির্ণয়ে চমৎকার পদক্ষেপ নিয়ে এসেছে।
কীভাবে এটি করা হয়
রোগীর শরীরে ছয় মিনিট এডিনোসিন ওষুধ দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে শরীরে খুবই স্বল্প মাত্রার আইসোটোপ পদার্থ দেওয়া হয়, যা পরে গামা ক্যামেরার সাহায্যে ছবি নেওয়া হয়। এ ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। কিন্তু যাঁদের হাঁপানি রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষাটি করা যাবে না।
রোগ প্রতিরোধ করতে হলে এর কারণ ও ঝুঁকিসীমা নির্ণয় খুবই জরুরি, জরুরি চিকিৎসার জন্যও। সুস্থ-সুন্দর-ঝুঁকিমুক্ত জীবনযাপন আপনার ভবিষ্যৎকে করে তুলতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যময়। আপনার দিকে তাকিয়ে আছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
তাই অবহেলা না করে যাঁরা হৃদরোগের ঝুঁকির পূর্ণ সীমানার মধ্যে বসবাস করছেন, তাঁদের উচিত হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিসীমা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সতর্ক হওয়া।
—————————
ডা· এস এম আল বাকের
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো, ৪ জুন ২০০৮
Leave a Reply