ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। যে সমস্যার কথা আপনি ছাপতে চান না, তা লিখে পাঠাবেন না। খামের ওপর অবশ্যই ছুটির দিনে মনের জানালা কথাটি লিখবেন।
—বি.স.
সমস্যা: আমার মা নেই। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান প্রথম বর্ষে পড়ি। মা তিন বছর আগে মারা গেছেন। মায়ের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। কষ্ট হয়। মায়ের কথা মনে পড়লে আমার আর পড়া হয় না। এমনকি রাতে ঘুম ভাঙলেও মনে পড়ে মায়ের স্মৃতি। মাকে বেশি মনে পড়ে, যখন বন্ধুদের মায়েরা ফোন করে তাদের খবর নেন। তখন আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগে, কান্না পায়। মাকে খুব অনুভব করি। এর প্রভাব আমার লেখাপড়ায় পড়ছে। আমার কোনো ভাই নেই। আমার আছে শুধু বাবা। বাবার বয়স ৬০ বছরের ওপরে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আর বাড়িতে যাব না। কিন্তু পারি না। আমি জানি, আমার মা কখনই ফিরে আসবেন না। এ অবস্থায় আমার পরীক্ষা চলছে। কিন্তু ঠিকমতো আমি পরীক্ষার পড়া চালিয়ে যেতে পারছি না।
সোহাগ জোয়াদ্দার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পরামর্শ : পরিবারে যদি শুধু এখন বাবা থেকে থাকেন, তাহলে তোমার বাড়িতে খুব একা একা লাগার কথা। আর বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গেও হয়তো তুমি খুব একটা গল্পগুজব করো না। আমাদের অনেক কাছের প্রিয় মুখগুলো আমরা যখন আর দেখতে পাই না, তখন যত কষ্টই হোক না কেন, সেটি সহ্য করার ক্ষমতা নিজের মধ্যেই খুঁজে নিতে হয়। মায়ের সঙ্গে কাটানো তোমার সুন্দর আর মিষ্টি স্মৃতিগুলো সারা জীবন মনের অনেক গভীরে অবশ্যই লালন করবে। তবে সেই সঙ্গে মা-কে মন থেকে বিদায় দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নাও। কারণ এটাই তো বাস্তবতা, যে মাকে এই জীবনে তুমি আর দেখতে পাবে না। তবে তাঁর আশীর্বাদ সবসময় তোমার সঙ্গে রয়েছে সেটাও সত্যি। তুমি যদি এতদিন পরও তার কথা ভেবে ভেবে পড়ালেখা ঠিকমতো না করো, তাহলে মায়ের স্বপ্ন তো পূরণ করতে পারবে না, তাই না? প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবে, তিনি যেন তাঁকে ভালো রাখেন। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তুমি নিজেকে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করো। নিজের যত্ন নেবে এবং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করবে, তুমি ভালো আছো কি না, কারণ তুমি ভালো না থাকলে, আশপাশে থাকা মানুষও কষ্ট পাবে, এ কথাটা খেয়াল রাখবে। অনেক শুভকামনা রইল।
সমস্যা: আমার বয়স ২৯। তিন বছর আগে বিয়ে করেছি। বিয়েটা ছিল ভালোবাসার। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রীর ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহ জাগে। সন্দেহটা অনেকের চোখে গুরুতর না হলেও, আমার মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। কেউ আমার স্ত্রীর সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে স্ত্রী সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। আবার কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললেও সন্দেহ জাগে। বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইলেও মন থেকে পারি না। আমি বুঝতে পারছি না, স্ত্রীকে অধিক ভালোবাসার কারণে এমন হচ্ছে, না আমার মানসিক কোনো সমস্যা আছে।
এম. জাকের, মদনহাট, চট্টগ্রাম।
পরামর্শ: মনে হচ্ছে তুমি প্যারানয়েড ডিসঅর্ডারে ভুগছো। এ ধরনের অসুস্থতায় কোনো স্পষ্ট কারণ ও ভিত্তি ছাড়াই মনে সন্দেহ তৈরি হয়। বিশেষ করে জীবনসঙ্গী বা ভালোবাসার মানুষকে বেশি সন্দেহ করার প্রবণতা থাকে। তোমার স্ত্রী-ও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে, তোমার এই অহেতুক সন্দেহের কারণে। তুমি দেরি না করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাহায্য নাও। যদি তিনি মনোচিকিত্সক বা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। আশা করি, সঠিক চিকিত্সা নিয়ে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। তোমার স্ত্রী-ও বুঝতে পারবে এটা অধিক ভালোবাসার জন্য নয়, তোমার অসুস্থতার জন্য ঘটেছে।
সমস্যা: এমন অনুভূতি কেমন যেন হুট করেই আসে। খুব কঠিন আর বড়ই অস্পষ্ট আবেগ। ব্যথাপূর্ণ, চাপানো কষ্ট যেন। হারানোর ভয় যেমন ঠিক, তেমনি হূদয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত খেলে যায়। হাহাকার অনুভব হয়, যখন নিবিড় বৃক্ষরাজির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখি, তখন আপনাতে ডুবে যাই। যখন প্রিয় কোনো সুর কানে ভেসে আসে, উভয় ক্ষেত্রেই বিহ্বল হয়ে পড়ি, কিছু ভালো লাগে না। তখন হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। সে সময় কোনো একজনের ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে। সরস ভালোবাসা। এটুকু আমার ডায়েরিতে লেখা কিছু অংশ। ওই রকম একজনকে পেয়েছি ভেবে আমি মনের কথা তাকে জানাই। সে যথেষ্ট দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবকের ভয়ে উভয় সংকটে ‘না’। এতে চিন্তা-চেতনা, সমগ্র সত্তাই এমন হয়ে গেছে যে আমি গুটিয়ে যাচ্ছি। মূক হয়ে যাচ্ছি। একা হয়ে নিজেকে অবহেলা করে, মিইয়ে যাচ্ছি। আমি রংপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। পারিবারিক সহানুভূতি নেই। আমি করব কী?
মো. আ. হাকিম, শালবন, রংপুর।
পরামর্শ : পারস্পরিক সম্মানবোধ, বিশ্বস্ততা এবং স্বচ্ছতা না থাকলে একটি সম্পর্ক কখনোই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। ফোনের মাধ্যমে যেসব সম্পর্ক হয়, সেখানে স্বচ্ছতার অভাব থাকাটা স্বাভাবিক। তুমি মেয়েটির চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছ। অবশ্যই আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আদর্শের দিক থেকে চিন্তা করলে, মেয়েটি অন্যায় কাজ করেছে। তোমার সঙ্গে ওর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো একই জিনিস ঘটেছে। তুমি কি নিজের চরিত্রের দিকটি নিয়ে ভেবেছ? তুমিও কিন্তু আমাদের সমাজের আদর্শ আর মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলে না। আশা করি, ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক হলে তুমি আগে তার সঙ্গে একটি সুস্থ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করবে। দুজন দুজনের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে একটি বোঝাপড়ার জায়গায় পৌঁছানোর পরই আসলে তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে দেখার প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়া দরকার। মেয়েটি যেহেতু এখন আর তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয়, এবং তোমারই বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে, এতে তোমার কষ্ট হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া এ মুহূর্তে তোমার আর কিছুই করার নেই। ধৈর্য ধরে নিজের মনকে বোঝাতে পারলে তুমি আবার সুস্থ মানসিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৩, ২০১০
Leave a Reply