অ্যাজালিয়া শীত মানেই পিঠা-পায়েস, খেজুরের রস। শীত মানে শত রকমের শীতের ফুল ফোটা। শীতে যত ফুল ফোটে, সারা বছরের আর কোনো সময় সেভাবে তত ফুল ফোটে না। মাত্র এক মৌসুমের আয়ু নিয়ে রংবেরঙের ফুলগাছ বাগান আলো করে ফেলে। শীতের ফুল বলতেই আমরা অনেকে ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস ইত্যাদিকেই বুঝে থাকি। আছে অ্যাস্টার, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, স্টক, পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, লুপিন, গ্ল্যাডিওলাস, ন্যাস্টারশিয়াম, লার্কস্পার, স্টার, ভারবেনা ইত্যাদি। কিন্তু এর সঙ্গে প্রায় এক শ রকমের ফুল আছে, যেগুলো এ দেশে শীতকালে ফোটে। তবে এসব ফুল আমাদের দেশের নয়, এসেছে অন্য দেশ থেকে। এসব ফুলের অধিকাংশ বীজও আসে বিদেশ থেকে। এ দেশে সেই বীজ থেকে চারা তৈরি করে লাগানো হয়। এ জন্য অতিথি পাখির মতো এসব ফুলকেও বলা যায় অতিথি ফুল। তবে এগুলোর মধ্যে অনেক ফুলই এ দেশের জল হাওয়ায় এমনভাবে মানিয়ে গেছে যে, ওদের আর এখন বিদেশি অতিথি ভাবতে কষ্ট হয়। দিন দিন যোগ হচ্ছে আরও নতুন নতুন ফুল। নতুন আসা এসব ফুলের মধ্যে অন্যতম হলো গাজানিয়া, অ্যাজালিয়া, চীনা হ্যাট ফ্লাওয়ার ইত্যাদি। জারবেরাও এসেছে কিছুদিন আগে। এ তিনটি ফুলের গাছ তিন রকমের। গাজানিয়া ফুলের গাছ ছোট, অনেকটা জারবেরার মতোই, টবেই ভালোভাবে লাগানো যায়। অ্যাজালিয়ার একটু ডালপালা হয়, গাছ মাঝারি, মাটি ও টবে লাগানো যায়। অন্যদিকে চীনা হ্যাট ফ্লাওয়ার লতানো প্রকৃতির, জন্মায় মাটিতে, এর জন্য অবশ্যই অবলম্বন দরকার হয়। হঠাত্ এ গাছ দেখলে বাগানবিলাস গাছ বলে ভুল হতে পারে। এ গাছটি বাঁচে কয়েক বছর। অ্যাজালিয়ার আয়ুও এক শীতের নয়। কিন্তু গাজানিয়া আর জারবেরা মৌসুমি ফুল। যাঁরা নতুন নতুন ফুলগাছের সংগ্রাহক, তাঁরা এ শীতেই ফুলসমেত এসব অতিথি ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগানকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
গাজানিয়া
গাজানিয়া গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে, তবে গাছের একটু লতানো স্বভাব আছে। পাতা সরু, লম্বা ও নিচের পাশ রুপালি সূক্ষ্ম পশমে আবৃত। ফুল বেশ বড়, দেখতে কিছুটা জারবেরা ও ডেইজির মতো। ফুলের মাঝের চাকতি থেকে পাপড়ির মধ্যখান বরাবর গাঢ় খয়েরি রঙের রশ্মির মতো লম্বা রেখা গাজানিয়াকে বেশি মোহনীয় করে তুলেছে। তবে দাগ ছাড়া একরঙা পাপড়ির জাতও গাজানিয়ার আছে। ফুলের রঙ সাধারণত হলুদ থেকে কমলা, তবে ঘিয়া, লাল, সাদা ও বাদামি রঙের ফুলও আছে। হাইব্রিড জাতগুলোর ফুলের পাপড়িতে লাল, কমলা, সাদা ইত্যাদি রঙের শেড থাকে। ফুল একটা ডাঁটার মাথায় ফোটে, ফোটার পর অনেকক্ষণ তাজা থাকে, বিকেলে শুকিয়ে যায়। বীজ সরাসরি বুনে গাছ তৈরি করা যায়, তবে কাটিং করেও নতুন চারা পাওয়া যায়। গাজানিয়া লাগাতে হবে রোদেলা জায়গায় এবং যেখানে পানি জমে না। গাজানিয়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Gazania splendens এবং পরিবার কম্পোজিটি। ফুলটি এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।
চীনা হ্যাট ফ্লাওয়ার
চীনা হ্যাট ফ্লাওয়ার লতানো স্বভাবের গাছ। তাই একে ফুল ফোটা অবস্থায় হঠাত্ দেখলে দূর থেকে বাগানবিলাস ফুলেরই কোনো একটা প্রজাতি বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু কাছে গেলেই সে ভুল ভাঙে। পাতাটা হুবহু বাগানবিলাসের মতো নয়, ফুল তো নয়ই। পোড়া ইটের মতো লালচে রঙের গোল গোল চাকতি আকৃতির ফুল ফোটে ডালে ডালে। ফুলের রঙ কখনো লাল বা হলুদ হয়। ফিনফিনে পাতলা পাপড়ি আর তা বসানো একটা খাটো সরু নলের মাথায়। চীনা টুপি ফুলের গাছ লতানো, লতিয়ে লতিয়ে ১০ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে মূল কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা চারদিকে দুলে পড়ে। চাকতির মতো গোলাকার বা ফুল দেখতে সসার বা পিরিচের মতো হলেও চারপাশে কিনারায় হালকা পাঁচটি খাঁজ থাকে। এ জন্য এ ফুলের আরেক নাম ‘Cup and Saucer plant’. ফলের রঙ বাদামি, চ্যাপটা গোল। প্রতিটি ফলের চারটি অংশ থাকে। কাটিং ও গুটি কলম করে চারা তৈরি করা যায়। হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে এ ফুলের জন্ম এবং সেখান থেকে আসাম হয়ে বাংলাদেশে বিস্তৃত। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Holmskioldia sangunea, ইংরেজি নাম Chinese Hat plant, পরিবার লেমিয়েসি।
অ্যাজালিয়া
লাল, গোলাপি, কমলা এবং সাদা রঙের অ্যাজালিয়া ফুল দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু গাছ তত আকর্ষণীয় নয়। জীর্ণশীর্ণ গাছে যে অমন বাহারি ফুল ফুটতে পারে, তা ফুল ফোটা অবস্থায় গাছটিকে না দেখলে বোঝা যায় না। এ জন্য এ ফুল ফুটলে তা গাছের চেয়ে ভালো দেখায়। গুচ্ছবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো ফুল একত্রে কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে ফুলদানিতে ভালো মানায়। সেদিক দিয়ে অ্যাজালিয়ার কদর রয়েছে। বিশেষ করে ক্রিসমাসের উত্সবের উপহারে অ্যাজালিয়ার জুড়ি মেলা ভার। অ্যাজালিয়া শীতের ফুল। কলকে বা চোঙার মতো কোনো কোনো জাতের ফুলে আছে নানা রঙের বৈচিত্র্য। গাছে ফুল থাকা অবস্থায় গোড়ার মাটি সব সময় ভেজা রাখতে হয়। টবে ও বাগানে অ্যাজালিয়া লাগানো যায়। শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলো সব সময় তুলে ফেলতে হবে। শাখা কলম করে অ্যাজালিয়ার নতুন চারা তৈরি করা যায়। টবে লাগানো গাছ সংগ্রহ করতে পারলে এ শীতেই হয়তো আপনার বাগানে ফুটতে পারে অ্যাজালিয়া ফুল। তবে গাছ রাখতে হবে একটু ছায়া ছায়া জায়গায় এবং খুব যত্নে। হাজার হলেও এ দেশে নতুন অতিথি। খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় তো দিতে হবে। অ্যাজালিয়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Rhododendron sp, পরিবার ইরিয়েসি। ফুলটি এসেছে চীন, তিব্বত বা জাপান থেকে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১২, ২০১০
Leave a Reply