পড়ার চাপে শিশুরা ক্লান্ত হয়ে যায়, মা-ই তখন একমাত্র ভরসা শেষ হয়েছে ভর্তিযুদ্ধ। নতুন শ্রেণীর ক্লাসও শুরু হয়েছে বা হয়ে যাবে।
নতুন বই পেয়ে উত্সাহ নিয়ে শিশুরা শুরু করেছে লেখাপড়া। কিন্তু এই রেশটা বেশি দিন থাকে না। কেননা, সারা বছরের পড়ার চাপে অনেক শিশুই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। স্কুলের প্রতিও অনীহা প্রকাশ করে। বেশির ভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটে। ফলে শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শিশুর পড়াশোনার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে, তবে কখনোই শিশু যেন বেশি চাপ বোধ না করে। বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন।
চাই পাঠ পরিকল্পনা
বছরের শুরুতেই শিশুর উপযোগী একটি মানসম্মত পাঠ-পরিকল্পনা করা উচিত। এমনটিই মনে করেন অরণি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসমাত সুলতানা। তিনি বলেন, ‘স্কুলের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সম্পৃক্ততাই পারে এ সমস্যা সমাধান করতে। ক্লাসে শিশু মনোযোগী হয়ে বাসায় গিয়ে একবার পড়াটা দেখলে মনে থাকে। শিশুকে এ কাজে সাহায্য করবেন অভিভাবক। তাঁরা সন্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বছরের শুরুতেই আলোচনা করে নিতে পারেন।’
তাঁর মতে, সরাসরি পড়াশোনা শুরু না করে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অভিভাবককেই কৌশলী হতে হবে।
সন্তানকে নিয়মিত, ঠিক সময়ে স্কুলে পাঠানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি প্রতিদিন স্কুল থেকে সন্তান ফিরলে গল্পের ছলে তার পড়াটা জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। বছরের শুরু থেকেই নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস করাতে হবে। তাহলে পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত চাপ পড়বে না। শিশুকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখানো উচিত। পড়াটা যেন না বুঝে মুখস্থ না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
চাপ দিয়ে কাজ হবে না
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে খেয়ে নিয়েই আবার পড়তে বসা। এমন রুটিন অনুসরণ করেন অনেক অভিভাবক। কিন্তু অতিরিক্ত চাপের ফলে সন্তান প্রয়োজনীয় পড়াটুকুও ভুলে যায়। বছরের শুরু থেকে স্কুলের ডায়েরি অনুযায়ী নিয়মিত পড়া তৈরি করে ফেললে কোনো সমস্যা হবে না। সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে সন্তানকে তটস্থ রাখা উচিত নয়।
আত্মবিশ্বাস গড়ে দিতে হবে
শিশু পরীক্ষায় একটু খারাপ করলে রাগ করা ঠিক নয়। শিশুকে বোঝাতে হবে যে সে ভালো করতে পারবে। এ আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। তবেই সারা বছরের নিয়মিত লেখাপড়ার ফল ভালো হবে। ছোট ছোট উপহার দেওয়ার পদ্ধতির মাধ্যমেও সন্তানকে উত্সাহিত করতে হবে। শুরু থেকেই যেকোনো সমস্যায় শ্রেণীশিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। সন্তান কেমন করছে, সেই খোঁজখবরও রাখতে হবে। ইসমাত সুলতানা এমনটাই মনে করেন।
নতুন ধরনের শিক্ষাপদ্ধতিতে পড়াশোনা
গত বছর থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। নতুন এ পদ্ধতি নিয়ে বাড়তি চিন্তার কিছু নেই। বছরের শুরু থেকেই সমাপনী পরীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সে প্রসঙ্গে কথা বলেছেন আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দিদার চৌধুরী। তিনি বলেন, এবারই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু হয়েছে। বছরের শুরুতেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীকে পাঠ্যসূচি, পাঠের পরিধি, পাঠ-পরিকল্পনা ও সমাপনী প্রশ্নকাঠামো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। অভিভাবককে নতুন ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। অযথা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করার দরকার নেই। বই পেয়েই অনুশীলনের প্রশ্নগুলো পড়ার দরকার নেই। প্রথমে মূল বিষয়টি ভালোভাবে পড়তে হবে। সেটি আত্মস্থ করতে হবে। তাহলে সৃজনশীলসহ যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হবে। শিশুকে চিন্তাভাবনার জন্য সময় দিতে হবে। শিশুরা অনেক সময় নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে চায় না। তখন তার পছন্দমতো অন্য বিষয়কেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এক দিনেই সব পড়ে ফেলতে হবে, এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। লেখাপড়াকে আনন্দময় করে তুলতে হবে সারা বছরই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম বলেন, বয়স ও স্কুলের শ্রেণী অনুযায়ী একেকজনের জন্য লেখাপড়াও একেক রকম হওয়া উচিত। আন্তরিকতার সঙ্গে সন্তানকে লেখাপড়ার বিষয়টি বোঝাতে হবে। প্রথম যারা স্কুলে যাচ্ছে, তাদের বেশি উত্সাহিত করতে হবে। কখনোই সন্তানের সামনে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়। মা-বাবার পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো হতে হবে। সন্তানের সামনে ঝগড়া কিংবা অভিযোগ করা উচিত নয়। শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান না দিয়ে অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। সন্তানের নানামুখী প্রশ্নে বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। ভালোভাবে জেনে সে বিষয়ে উত্তর দেবেন। তার ইচ্ছার মূল্যায়ন করা উচিত। শিশুর পছন্দমাফিক সময়ে তারা পড়াতে বসাতে পারেন। শিক্ষার মূল্যবোধ এমনভাবে তার মধ্য ঢুকিয়ে দিন, যাতে সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে লেখাপড়া করে। এটাই ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আর পড়াশোনার গতিধারা বছরজুড়েই সমানভাবে চলা উচিত। কম-বেশি হলেই সমস্যা দেখা দেয়।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে খাওয়ার পরই শিশুকে আবার পড়তে বসানো উচিত নয়
শিশু পরীক্ষায় একটু খারাপ করলে রাগ করা ঠিক নয়
পড়াশোনায় ভালো করলে ছোট ছোট উপহার দেওয়া যেতে পারে
এক দিনেই সব পড়ে ফেলতে হবে, এমন ধারণা ঠিক নয়
আন্তরিকতার সঙ্গে সন্তানকে পড়ার বিষয়টি বোঝাতে হবে
তৌহিদা শিরোপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১২, ২০১০
Leave a Reply