চোখের সামনে দুই দুইটা নাতনি ঈদের সারা দিন কাটাল নিরানন্দে। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকল না।— বলতে বলতে ভিজে ওঠে মৌলুদা বেগমের দুই চোখ।
মনে কি পড়ে এই মৌলুদা বেগমকে?
যিনি কাপড়ে সুঁই-সুতা দিয়ে এঁকেছেন পৃথিবীর প্রায় দেড় হাজার মানুষের মুখচ্ছবি। রাজা রামমোহন রায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সুচিত্রা সেন, মুহাম্মদ ইউনূস, বীণা সিক্রি থেকে রানী মুখার্জি—কেউই বাদ পড়েননি তাঁর সুচিকর্মের প্রতিকৃতির তালিকা থেকে। তাঁর এই অসাধারণ সুচিকর্ম নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে প্রথম আলোয়। দেশের সব কটি দৈনিক পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন। এখন কেমন আছেন এই সুচিশিল্পী?
৯৬৮ শেওড়াপাড়া, ঢাকা—এ বাড়ির তিন তলায় দুই নাতনি, ছেলে ও ছেলের বউ নিয়ে মৌলুদা বেগমের সংসার। দরজা খুললেই চোখে পড়ে তাঁর ঘরটি। মেঝেতে ছিন্নভিন্ন তোশকের ওপর ছেঁড়া চাদর বিছিয়ে মলিন পোশাকে শুয়ে ছিলেন এই শিল্পী। মাসখানেক আগেই চোখের ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। ঘরের চারদিকে মেঝে থেকে দেয়াল পর্যন্ত শোভা পাচ্ছে কীর্তিমান অনেক ব্যক্তির প্রতিকৃতি। এই প্রতিবেদককে দেখামাত্রই বিছানায় উঠে বসলেন এবং লজ্জিতমুখে অস্থির হয়ে পড়লেন, কোথায় বসতে দেবেন ভেবে। মেঝের একপাশে বসেই শুরু হলো কথোপকথন। বললেন, ‘সংসারের সবার সঙ্গে খেয়ে না-খেয়ে দিনগুলো পার করছি।’ জানালেন, নয় মাস আগে তাঁর ছেলের যকৃতে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় এবং শরীরে ধরা পড়ে অসংখ্য টিউমার। শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন বড় ছেলে। সংসারের হাল ধরতে বড় ছেলের বউ ছোটখাটো চাকরি করছেন একটি ক্লিনিকে। তাঁর এই স্বল্প আয়ে তাঁদের দৈনন্দিন খাবারও ঠিকমতো জোটে না। তারপর নাতনি দুটোর পড়ার খরচ, ছেলের ও মৌলুদা বেগমের ওষুধের খরচ চালাতে প্রায় হিমশিম খেতে হয়। কয়েক মাসের বাড়িভাড়াও বাকি পড়েছে। প্রায়ই বাড়িওয়ালা তাঁদের বিদ্যুত্ ও পানির সংযোগ বন্ধ করে দেন। আবার ঘর থেকে জিনিসপত্র বের করে দেওয়ার কথাও বলেন। ‘আসলে বাড়িওয়ালারই বা কী দোষ? এই বাড়িভাড়ার টাকাতেই তাঁর সংসার চলে’— বললেন মৌলুদা বেগম। একসময় নিজেই ছিলেন বড় সচ্ছল সংসারের গৃহিণী। সেই পুতুলখেলার বয়সে বাপেরবাড়ি ছেড়ে স্বামীর সংসারে আসা। আভিজাত্য ও সচ্ছলতায় ভরা ছিল সেই সংসার। সন্তানদের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধ, তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বামীর চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার কথা বলেন মৌলুদা বেগম। ভালোই চলছিল সেই দিনগুলো। বিদেশে যাওয়ার কিছুদিন পর হূদরোগে আক্রান্ত হন তাঁর প্রকৌশলী স্বামী নাসিমউদ্দীন সিদ্দিকি। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে আনেন মৌলুদা বেগম। তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য দরকার ছিল প্রচুর টাকার। নিজেদের যা অর্থ বা সম্পদ ছিল, তাও স্বামীর চিকিত্সার খরচের তুলনায় অপ্রতুল। একসময় কী করবেন, ভেবে না পেয়ে আত্মীয়স্বজনের দারস্থ হন তিনি। কেউই বাড়িয়ে দেয়নি সহযোগিতার হাত। একরকম বিনা চিকিত্সায় মারা যান নাসিমউদ্দিন।
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন মৌলুদা বেগম। কারও সহযোগিতা ছাড়াই সন্তানদের বড় করার জন্য এবার একাই জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। যে সুঁই-সুতা একসময় ছিল নিছক শখ, সেই সুঁই-সুতাই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা ও বাসাবাড়ি থেকে অর্ডার এনে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। একসময় এলাকার দুস্থ মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তাদের দিয়েও করালেন সেলাইয়ের কাজ। অবস্থা ফিরতে থাকে আবারও। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন খুব ঘটা করে। দুই ছেলেকেও বিদেশে পাঠান। এমন সময় বড় ছেলেও পেয়ে যান ভালো একটা চাকরি। বড় ছেলের সঙ্গেই থাকেন মৌলুদা বেগম। ধীরে ধীরে বয়সের ভারে হারিয়ে যেতে থাকে মৌলুদা বেগমের কর্মক্ষমতা। ফরমায়েশ এনে কাজ করা, আবার সেই কাজ বুঝিয়ে দেওয়া—এসব আর কুলোয় না তাঁর শরীরে। ছেলেও তখন মাকে বাধা দেন কাজ করতে। তখন সেই শখের কাজ কীর্তিমান ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি তৈরি করার পাশাপাশি নাতনিদের নিয়েই হাসি-আনন্দে কাটতে থাকে তাঁর দিনগুলো। কিন্তু আবারও বিপদ এসে হানা দেয়। বড় ছেলের অসুস্থতার কারণে সংসারে নেমে আসে আর্থিক অনটন, নিজে যে সংসারের হাল ধরবেন সেলাই করে, সেই উপায়ও নেই। কারণ তাঁর দুই চোখেই যে ছানি পড়েছে। এ সময় এগিয়ে আসেন বিধান নামের হাঙ্গার প্রজেক্টের এক কর্মী। একসময় সেখানে সেলাই শেখাতেন মৌলুদা বেগম। বিধান টাকা জোগাড় করে মৌলুদা বেগমের একটি চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করান।
যেদিন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, এর মাত্র সাত দিন আগেই এক চোখে ছানির অস্ত্রোপচার করিয়েছেন মৌলুদা বেগম। সেই চোখ দিয়েই ছেলে ও তাঁর বউয়ের আড়ালে লুকিয়ে আবারও শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। মৌলুদা বেগম বলেন, ‘একটা সময় ছিল, যখন ঈদে শুধু আমার ঘর সাজানো দেখতেই আসত বেশির ভাগ অতিথি। সেই ঈদগুলো যে কী আনন্দের ছিল! অথচ এখন ঈদের দিনগুলোতে দুটো নাতনির মুখে একটুও ভালো খাবার তুলে দিতে পারি না। শখের কোনো পোশাক-আশাক কিনে দিতে পারি না।’ একসময় ৩৫০ জন নারীকে বিনা পারিশ্রমিকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তাঁরা সবাই আজ স্বাবলম্বী। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখতে এসে হাতখরচের জন্য কিছু টাকাও দিয়ে যান তাঁরা। দুই ছেলে প্রবাসী হলেও তাঁদের সংসারই ঠিকমতো চলে না। তাই চাইলেও মাকে সাহায্য করতে পারেন না তাঁরা। কিন্তু এভাবে দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে বাঁচতে চান না মৌলুদা বেগম। একসময় যে শিল্পকর্মগুলো (কীর্তিমান ব্যক্তিদের মুখাবয়ব) ছিল তাঁর কাছে যক্ষের ধনের মতো, শতকিছুর বিনিময়েও যেগুলো তিনি টাকার মূল্যে বিক্রি করতে চাইতেন না, আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে টিকে থাকতে এই শিল্পকর্মগুলো বিক্রি করে তিনি চান কিছু সম্মানী পেতে। ‘আসলে মা, কী হবে এই শিল্পকর্মগুলো দিয়ে, যেখানে নিজের অসুস্থ ছেলেটাকে একটু ফলও কিনে খাওয়াইতে পারি না। একজন মায়ের এর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কী হতে পারে’—বললেন মৌলুদা বেগম। সবসময় একটা স্বপ্ন লালন করতেন মৌলুদা বেগম, একদিন তাঁর এই কীর্তিমান ব্যক্তিদের মুখচ্ছবিগুলো স্থান পাবে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে। কিন্তু আজ অনেকটাই ছানিপড়া চোখের মতো ম্রিয়মাণ তাঁর সেই স্বপ্ন। বেঁচে থাকার তাগিদে এই অসাধারণ শিল্পকর্মগুলো হাতছাড়া করতে চাইছেন তিনি। আমরা কি পারি না, এই উপেক্ষিত সুচিশিল্পীর অসাধারণ সুচিকর্মগুলো বাঁচিয়ে তাঁকে সম্মানিত করতে? একদিন হয়তো বা তাঁর নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় সুতা-সুঁই দিয়ে করা কীর্তিমান ব্যক্তিদের মুখচ্ছবি আমাদের দেশের জন্য নিয়ে আসবে এক বিরাট সম্মান।
বিপাশা রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৬, ২০১০
Leave a Reply