মফি ও বাপ্পী নামে গ্রামের প্রভাবশালী বখাটে দুই সন্ত্রাসী যুবকের ভয়ে মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদী দাসপাড়ার মেয়ে কুমারী অনামিকা দাসের কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বখাটেরা কলেজে যাওয়ার পথে তাকে দুবার অপহরণের চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ আছে। বখাটেদের নানা অপচেষ্টা ও হুমকির কারণে অনামিকা প্রায় আট মাস কলেজে যাওয়া বন্ধ করে ভয়ে গৃহবন্দিত্ব মেনে নিয়েছে। সে মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কিছুদিন পর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়াও তার অনিশ্চিত। কেননা, বখাটেদের ভয়ে সে কলেজের কয়েকটি ক্লাস টেস্ট পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারেনি। এ ব্যাপারে মেহেরপুর জজ আদালতে সে মামলা করলেও বখাটে সন্ত্রাসীদের হুমকি এখনো থামেনি। মেহেরপুরের পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন জানান, বখাটে সন্ত্রাসীদের ভয়ে কলেজছাত্রী অনামিকার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে—বিষয়টি তাঁরা জানেন। আসামিদের আটক ও অনামিকার কলেজে যাওয়া নিশ্চিত করতে পুলিশ ভূমিকা নেবে বলে তিনি জানান।
মেহেরপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বখাটেদের কারণে তাঁর কলেজের ছাত্রী অনামিকার কলেজে না আসার ঘটনাটি মেয়েদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনের পথ রুদ্ধ করার সামিল। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও আতঙ্কের। প্রয়োজনে অনামিকাকে মেয়েদের হোস্টেলে রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুচালা কাঁচাপাকা ঘরের এক কোণে বিষণ্ন মনে চুপচাপ বসে আছে অনামিকা। বাবা জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। মা গৃহিণী। তার অভিযোগ, বখাটেরা দিনের পর দিন তাকে কলেজে যেতে দিচ্ছে না। অথচ এর কোনো প্রতিকারও নেই। তাই পড়াশোনা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে সে। বাইরে বের হলেই বখাটেরা তার পিছু নেয়। তাদের কারণে প্রাইভেট পড়াও বন্ধ তার। ওরা বলে, ‘আমি নিম্নধর্মের মেয়ে, উচ্চশিক্ষার অধিকার আমাদের নেই’ এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে অনামিকা।
মেহেরপুর জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় অনামিকার অভিযোগ, মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের বারাদী মোমিনপুর গ্রামের নবিছুদ্দিন সাহার ছেলে মফি (৩০) ও বারাদী কলাইডাঙ্গা গ্রামের নাসিরউদ্দিনের ছেলে বাপ্পী (২৮) স্কুলজীবন থেকেই তাকে উত্ত্যক্ত করে। এলাকায় তারা প্রভাবশালী ঘরের বখাটে ও সন্ত্রাসী যুবক বলে পরিচিত। ২০০৮ সালে তাদের অত্যাচারে সে স্থানীয় কলেজ বাদ দিয়ে মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু বখাটেরা তার পিছু ছাড়েনি। তাকে নানা সময় বাজে প্রস্তাব, অশ্লীল উক্তি করাসহ অপহরণের হুমকি দেয়। গত ১১ মে মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বখাটে ওই দুই যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে তার পিছু নেয়। যুবকেরা মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ডের অদূরে প্রকাশ্য রাস্তায় তাকে টেনেহিঁচড়ে মোটরসাইকেলে তোলার অপচেষ্টা চালায়। এ সময় তার চিত্কারে পথচারীরা এগিয়ে এলে বখাটেরা পালিয়ে যায়। ওই দিনই সে স্থানীয় বারাদী পুলিশ ক্যাম্পে অভিযোগ দিলেও পুলিশ ঘটনাটি আমলে নেয়নি। ১৩ মে যুবকেরা তাঁর ওপর একইভাবে হামলা চালিয়ে অপহরণের চেষ্টা করে। গত ২২ মে মা-বাবাকে নিয়ে সে মেহেরপুর সদর থানায় গেলে থানাও মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে গত ২৮ জুন অনামিকা বাদী হয়ে ওই দুই যুবক মফি ও বাপ্পীকে আসামি করে মেহেরপুর জজ আদালতে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মামলা করে। আদালত অনামিকার মামলাটি নথিভুক্ত করে এজাহার হিসেবে তা গণ্য করে আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু আসামিদের আটকে পুলিশের তত্পরতা নেই বলে অনামিকার অভিযোগ।
তার মা প্রতিমা রানী দাস ও বাবা গোপাল চন্দ্র দাস জানান, এর আগে এলাকার ওই দুই যুবকের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বড় মেয়ে অলোকার পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে। এবার তারা ছোট মেয়ের পিছু নিয়েছে। মেয়ের নিরাপত্তা চেয়ে তাঁরা ঘটনাটি পুলিশ, আদালত ও জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছেন। এর পরও বখাটেরা ক্ষান্ত হয়নি। বাবা গোপাল চন্দ্রের প্রশ্ন, তাহলে নিম্ন হিন্দু পরিবারের মেয়েরা কি উচ্চশিক্ষা নিতে পারবে না? মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী অনামিকার সহপাঠী রিজিয়া সুলতানা জানায়, বখাটেদের উত্পাতে অনামিকার কলেজে আসা বন্ধের ব্যাপারে তারা কয়েকবার প্রতিবাদ কর্মসূচি হাতে নিলেও চারদিকের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা ভেবে সেই কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। মেহেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম জানান, আসামিদের আটকে পুলিশি চেষ্টা অব্যাহত আছে। পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন জানান, অনামিকা ও তার বাবা তাঁর কাছে ঘটনার প্রতিকার চাইতে এসেছিলেন। তিনি অনামিকার কলেজে যাওয়া নিশ্চিন্তকরণে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
তুহিন আরণ্য, মেহেরপুর প্রতিনিধি
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৬, ২০১০
Leave a Reply