সৌদামিনী শর্ম্মা আন্দোলন-সংগ্রাম কাকে বলে, কিংবা লড়াইটা কীভাবে করতে হয়—কিছুই জানা নেই। তবু একদিন হঠাত্ করেই সৌদামিনী শর্ম্মা সন্ধ্যার অন্ধকারে একদল নারীর হাতে মশাল তুলে দিয়ে পথে নামলেন। তাতে অন্ধকার শুধু কেঁপেই উঠল না, মশালের কাঁপা আলোয় অনেক দূরের পথ চোখের সামনে খুলে গেল। বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসা সৌদামিনী শর্ম্মা বললেন, ‘এটাই আমার প্রথম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘটনা। এর আগে আন্দোলনের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।’
সৌদামিনী শর্ম্মা এখনো মনে করতে পারেন সেই অন্ধকারে আলোর মশাল নিয়ে পথে নামার দিনটির কথা। এটা যে শুধু তাঁরই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল তা নয়, এলাকাবাসীর চোখ খোলারও দিন এটি। এই প্রথম তাঁরা দেখলেন, একদল নারী হাতে লাল শিখা ছড়ানো আলোর মশাল নিয়ে পথ পার হচ্ছেন। স্লোগান দিচ্ছেন। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মণিপুরি অধ্যুষিত আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁওয়ে সৌদামিনী শর্ম্মার বাড়ি। বাড়ির কাছেই আদমপুর বাজারে প্রতিদিন নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করে। বাজারটির আশপাশে বেশ কিছু স্থানে চলত মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসর। গ্রামের ভেতর প্রায়ই মাদকসেবীদের আড্ডা হতো। মাতাল হয়ে একে অন্যের সঙ্গে মারামারি, ঝগড়াঝাটি করত। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে ঘরের ভেতর বসে থাকতেন। সৌদামিনী শর্ম্মা বলেন, ‘এ অবস্থাটা মন থেকে মেনে নিতে পারতাম না। সব সময় চিন্তা করতাম, কীভাবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ’
একদিন একটি দরিদ্র পরিবারের এক পুরুষ মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় বাড়ি এসে স্ত্রীকে নির্যাতন করে। সেই স্ত্রী নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন। আর তাতেই চোখ খুলে যায় সৌদামিনী শর্ম্মার। তিনি ভাবলেন, ‘ঘরের পুরুষেরা মাতাল হয়ে এসে বউ-ঝিদের ওপর অত্যাচার চালালে মেয়েরা মুখ দেখাবে কী করে!’ ভাবনাটা নিয়ে তেতইগাঁয়ের অপরাপর নারীদের সঙ্গে কথা বললেন। সবাই উপলব্ধি করলেন, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা। সৌদামিনী শর্ম্মা বললেন, ‘আমরা আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললাম। যুবকদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বলল, “সেটা তো ভালো কাজ। সবাই তো চাইছি, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে”।’
মাদকাসক্ত ও জুয়াড়িদের প্রতিরোধের সাহস নিয়ে একদিন সৌদামিনী শর্ম্মার নেতৃত্বে পথে নামলেন একদল নারী। সেদিন ছিল ২০০৮ সালের ৭ মে। সন্ধ্যায় যেসব স্থানে মদ, জুয়া বা গাঁজার আসর বসত, সেখানে গিয়ে তাঁরা আড্ডা ভেঙে দিলেন। আদমপুর বাজারে এ রকম পরপর বেশ কয়েক দিন মশাল মিছিল চলল। মণিপুরি ভাষায় স্লোগান তুললেন, জু থাকপা জুয়ার সনাবা, য়ারই য়ারই (মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, চলবে না চলবে না), জু জনবা গাজা জনবা, য়ারই য়ারই (মদ বেচা, গাঁজা বেচা, চলবে না চলবে না), নুপি নাহাদা ফুবা চৈবা, য়ারই য়ারই (মহিলাদের নির্যাতন, চলবে না চলবে না), নুপি অখইশু মিনি, মি মা ওইনা হিংগনি (মহিলা আমরাও মানুষ, মানুষের মতো বাঁচতে চাই) ইত্যাদি। তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মশাল মিছিলে অংশ নেন সে সময়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আলকামা সিদ্দিকী, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাম্মাত্ হাজেরা খাতুন প্রমুখ। সৌদামিনী শর্ম্মা জানান, এরপর আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর রহমানের উদ্যোগে গ্রামের মণ্ডপে বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে মাদক সমস্যা নিয়ে আলাপ হয়। তখনই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের যে ঐক্য গড়ে উঠছে, তাকে আরও শক্ত ভিত্তি দিতে হবে। তখনই সবার সম্মতিতে নতুন একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। নাম দেওয়া হয় ‘মৈরা পাইবি মহিলা সমিতি।’ মৈরা পাইবি হচ্ছে ‘মশালধারী’, অর্থাত্ মশালধারী মহিলা সমিতি। সৌদামিনী শর্ম্মা বলেন, ‘এখন এলাকায় মদ, জুয়া বা গাঁজার আসর বসে না। কোনো গন্ডগোল নেই।’
নারী দ্বারা পরিচালিত হলেও এটি আর শুধু নারীদের সমিতি থাকেনি। সংগঠনের নাম হলো ‘মৈরা পাইবি সমাজকল্যাণ সংস্থা।’ সংগঠনের ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সভানেত্রী হলেন সৌদামিনী শর্ম্মা আর সম্পাদিকা রিতা দেবী। সৌদামিনী শর্ম্মা জানান, তাঁদের সংস্থার ৩৩ জন সদস্য আছেন। তাঁরা প্রত্যেকে প্রতি সপ্তাহে ১০ টাকা করে চাঁদা দেন। তাঁদের তহবিলের উত্স সদস্যদের এই চাঁদাই। তবে মাদকবিরোধী দিবস বা অন্য কোনো বড় অনুষ্ঠান হলে সংগঠনের উপদেষ্টা ও চাকরিজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ রোড শো উপলক্ষে মৌলভীবাজারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সৌদামিনী শর্ম্মাকে ‘সাদামনের মানুষ’ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সৌদামিনী শর্ম্মা বললেন, ‘মশালের আলো শুধু এখানে নয়, অন্যখানে, সবখানে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
আকমল হোসেন, মৌলভীবাজার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৬, ২০১০
Leave a Reply