‘দোস্ত এখন রাখছি, ক্যান্টিনে আয়, বাকিটা তখন বলব।’- কলেজ বা ভার্সিটির ক্যাম্পাসগুলোতে এ ধরনের কথা নিয়মিতই শোনা যাবে। টিচারদের গৎবাধা লেকচার, একঘেয়েমী ক্লাস এসব কিছুর মাঝে নিজেকে একটু আলাদা করে প্রকাশ করার জায়গা এই ক্যান্টিন। ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারা, চা খাওয়া, টেবিল চাপড়ে গান গাওয়া এসব দেখে আপাতত দৃষ্টিতে বিরক্ত লাগলেও, দূরন্ত কৈশোরের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু এটাই, এভাবেই বেরিয়ে আসে সম্ভাবনা। তরুণদের আড্ডাস্থল ‘ক্যান্টিন’ নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। লিখেছেন আবরার হোসেন
সুশীল সমাজের ধারণা বনাম আমরা যা মানি
স্কুল শেষ করে কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আপনি যখন ভার্সিটিতে পদার্পণ করবেন তখন কিন্তু শুধু বইয়ের দিকে চোখ গুঁজে বসে থাকার দিন শেষ। বিশ্বকে চেনার এই পাঠশালায় শুধু কেতাবী বিদ্যা অর্জন করে যদি মনে করে থাকেন ডিগ্রীটা জব্বর হয়েছে তাহলে ভাবুন যে আপনার মানসিকতা স্কুলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। প্রচন্ড আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়, অন্যকে চেনা, বিশ্বকে জানা এসব কিছু এখন আর শুধু ফাঁকিবাজদের অভিধানে আটকা পড়ে নেই। আর এসবের জন্য সবচেয়ে উপযুুক্ত হচ্ছে ক্যান্টিন। ক্যান্টিন মানেই যে বখে যাওয়া, ক্লাশ পালানো তা কিন্তু নয়। সারাদেশের আর দশটা ছেলের সাথে মানিয়ে চলার যে মানসিকতা এবং শেয়ার করা যে মনোভাব ক্যান্টিন থেকে পাওয়া যায় তা কিন্তু দু’চারটা ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার চেয়ে কম দামি নয়। আর বর্তমান যুগে তো স্মার্ট ছেলেদের অবাধ বিচরণ ক্যান্টিনগুলোতে। হাল ফ্যাশন, বর্তমান রাজনীতি, কোন মুভিটি ভাল চলছে, কোন উপন্যাসটি সবচেয়ে জনপ্রিয় এসব ব্যাপারে যদি আপনি ধারণা নাই রাখেন তাহলে তো পড়ে যাবেন সেকেলেদের দলে।
তারপরে আসি শেয়ার করার ব্যাপারটায়। ধরুন আপনি বাবা মায়ের একমাত্র আদরের ছেলে। জীবনে ফুলের আচড়টি লাগলেও কেঁদে ফেলেছেন, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন অন্য সবার থেকে। কলমটি, খাতাটি আগলে রেখেছেন সবসময়। আজ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকালে আপনি যদি একইরকম আচরণ করেন তবে শিক্ষাটা কতটা উচ্চ হবে সেটা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। গুটিয়ে রাখা এসব ছেলে বা মেয়েদের জন্য সামাজিক হওয়ার স্থান হচ্ছে এই ক্যান্টিন। এটা কিন্তু তাদের মানসিকতা বিকাশে একরকম জরুরিই বলা চলে। দু’টা চা চারভাগ করে খাওয়া, বিলটা ভাগাভাগি করে পরিশোধ করা এসব ম্যানার তো ক্যান্টিন থেকেই শেখা যায়।
স্বাধীন মতামত বা নেতৃত্ব
প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজে চোখ বুলাই না এরকম মানুষ আমরা কমই আছি। চোখ বুলাই বটে কিন্তু ক’টা খবর নিয়ে একটু চিন্তা করি। সময় কোথায় বলুন? বিস্তর সময় কিন্তু পড়েই আছে। আড্ডার সময় যখন ওই সকালে পড়া খবরটার কথাই ওঠে তখন কিন্তু নিজের অজান্তেই বলে ফেলি অনেক কথা। যা নিয়ে হয়ত এভাবে কখনই ভাবিনি। এভাবেই বেরিয়ে আসে মতামত। রাজনীতি নিয়ে যে যাই বলুন না কেন, রাজনীতি সম্বন্ধে ধারণা না থাকলে নাগরিকত্বটা কিন্তু ওই অর্থে পাকাপোক্ত হয় না। আজকের ‘মধুর ক্যান্টিনে’র কথা কে না জানে। সেই ’৫২ থেকে আজ অব্দি কত রাজনৈতিক চেতনাই না বের হয়ে আসছে এই মধুর ক্যান্টিন থেকে।
পলিটিক্স ছাড়াও আলোচনার আছে অনেক কিছু। ক্যান্টিনে কথার ডালপালা ছাড়ায় বিভিন্ন দিকে। আন্তর্জাতিক বিষয়, ক্যারিয়ার, শিল্প, সংস্কৃতি কি নেই এখানে। এই ক্যান্টিন থেকেও কিন্তু হয় সংস্কৃতির চর্চা। বহু তরুণের টেবিল কাপড়ে গান গাওয়ার ফসল আজকের অনেক বিখ্যাত গানের দল। আর তাদের অনেকেরই কিন্তু রোজগার পাতির শুরু ছাত্রজীবনেই গান গেয়ে গেয়ে। বহু কল্যাণমুখী সংস্থা, সাংস্কৃতিক সংঘ এভাবেই গড়ে ওঠে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে। আর এখানেই প্রমাণিত হয় যে ক্যান্টিন শুধু আলসদের জায়গা নয়।
হাল আমলের ছেলেমেয়ের যত চিন্তা ফ্যাশনে নিয়ে। লেটেস্ট ফ্যাশন, কোন শপিং মলের কোন ড্রেসটা দূর্দান্ত, কোন পোশাকটিতে নিজেকে মানাবে বেশ, সবই আলোচনা হয় ক্যান্টিনে। সব কিছুর পরেও পড়াশোনার কথা যে মোটেই হয় না তা কিন্তু নয়। গ্রুপ স্টাডিজ, এ্যাসাইনমেন্ট তৈরির উপযুক্ত জায়গা এই ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনে আড্ডা মারতে মারতেই আপনি আপডেট হতে পারবেন সাম্প্রতিক বিশ্ব সম্পর্কে, ধারণা নিতে পারবেন চাকরির বাজার সম্বন্ধে। তাই ক্যান্টিন এখন আর নষ্ট ছেলেদের জায়গা নয়, বরং ক্যান্টিন তরুণদের জায়গা, মেধাবী আড্ডাবাজদের জায়গা। ইউনিভার্সিটি বা কলেজ জীবনে ক্যান্টিনের উপযোগীতা কখনোই বাদ দেওয়া যাবে না।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ০২, ২০১০
Leave a Reply