একটা সময় ছিল যখন নির্মল বিনোদনের অনেক শক্ত মাধ্যম ছিল বইপড়া, এখনও আছে। যদিও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে আজ আমাদের সমাজেও বই পড়ার প্রবণতা কম দেখা যায়। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মাঝে সময় কাটানোর জন্য বই পড়ার প্রতি এখন আর তীব্র আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। টিভি দেখা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, গান শোনা বা কম্পিউটার গেমস খেলতেই আজ তরুণরা অধিক স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের দৈনিক রুটিনে খুব কম সময়ই থাকে বই পড়ার জন্য। এমনকি যারা নিতান্ত প্রয়োজনে বই পড়েন, বদলে গেছে তাদের বই পড়ার স্টাইলও। বর্তমানে তরুণ সমাজের মাঝে ‘সফট রিডিং’ নামে একটি নতুন শব্দ শোনা যায়। তারা কম্পিউটারের উপর এতো বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে বইয়ের পাতা ঘেটে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে তরুণরা বড় বেশি নারাজ। তারা ইন্টারনেটে সার্চ করে প্রয়োজনীয় তথ্য ডাউনলোড করে নেয়। তরুণদের এই পরিবর্তনটা ঘটেছে খুব দ্রুত এবং বোধকরি তা কিছুটা হলেও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মাত্র কয়েক বছর আগের কথা বই পড়ার অভ্যাস ছিল অনেকটা শখের মতো। শিক্ষিত তরুণদের ঝোঁক দেখা যেত বইপড়া, বিভিন্ন রকম বই জমানো ইত্যাদি দিকে। আজকের তরুণ তরুণীরা যেমন সিডি, ভিসিডি জমায় তেমনি তখন তারা বইয়ের পাহাড় জমিয়ে গর্ববোধ করত। নিয়মিত লাইব্রেরীতে ঢুঁ মারা ছিল পরিচ্ছন্ন রুচির পরিচায়ক। নির্দিষ্ট পাঠ তালিকার বাইরেও তারা নানা ধরনের কলাম, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা কবিতা ইত্যাদি পড়তে আগ্রহী থাকত। পাশাপাশি বই পড়ায় আগ্রহী করতে তখন একটা সামাজিক জোয়ারও ছিল। প্রতিটি মহল্লায় তখন লাইব্রেরী বা ক্লাব প্রথা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ক্লাবগুলো তাদের সদস্যদের জন্য বই রাখত এবং তাদেরকে উৎসাহিত করত। তরুণদের মধ্যে ছিল একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা। ভালো মানের অধিক সংখ্যক বই সংগ্রহের মতো এই প্রতিযোগিতা তরুণদের পাশাপাশি বয়স্কদের মাঝেও দেখা যেত। কিন্তু দুঃখজনক বই পড়া এবং সংগ্রহ করার সেই প্রথা আজ যেভাবেই হোক হারিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন বই পড়ার অভ্যাস পাল্টে দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাত্র একটি মাউসের ক্লিকেই যেখানে চোখের সামনে ভেসে উঠে জানা অজানা নানা তথ্য সেখানে বইয়ের পাতায় মুখ গোঁজার আগ্রহ আজ না জাগাই স্বাভাবিক। শুধু ইন্টারনেট ব্রাউজই নয়, সময় কাটানোর বিস্তর পথ খোলা রয়েছে কম্পিউটারে। আজকাল তরুণরা বইপড়ার পাশাপাশি মাঠে যাওয়াও ভুলে গিয়েছে। কম্পিউটার গেমস নামক একটি শব্দই ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে রাখতে সক্ষম। কেউ আবার কম্পিউটারে সিনেমা দেখে বা গান শুনে অভ্যস্ত। তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস থেকে দূরে সরে আসার পিছনে আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ। দিনভর ক্লাস, পরীক্ষা এবং এ্যাসাইনমেন্টের ভীড়ে বাড়তি বই পড়া বা লাইব্রেরীতে ঢোকার সময় বের করা তাদের জন্য আসলেই কষ্টকর। প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান সময়ে অনেকে খবরের কাগজ পড়ার সময় পায়না মাঝে মধ্যে। অনেক সময় তারা বিস্তারিত খবর বাদ দিয়ে শুধু শিরোনাম পড়ে।
সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরে একজন ব্যক্তি যখন বাসায় ফেরে তখন তার দরকার হালকা বিনোদন। সারাদিনের বিরক্তিকর ক্লান্তি কাটাতে সে তখন হাতের মুঠোয় গুজে নেয় টিভির রিমোর্ট। অলসভাবে টিভি প্রোগ্রামগুলো দেখতে যেখানে কোনো ক্লান্তি নেই সেখানে বই পড়তে গেলে দরকার হয় ‘ব্রেন ওয়ার্ক’। বর্তমানে ছাপানো কাগজের চেয়ে টিভি প্রোগ্রাম বহুগুনে জনপ্রিয়। কারণ এখানে কল্পনা করতে হয়না। ভিজ্যুয়াল দৃশ্যগুলো চোখের সামনেই ভেসে ওঠে যেখানে বই পড়ে একজন পাঠককে নিজের মনেই দৃশ্যায়ন করে নিতে হয়।
আজকের বিতর্ক তথ্য প্রযুক্তির বিপক্ষে নয়। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলেই বিশ্ব আজ এতটা এগিয়ে তবে বইয়ের বিকল্প আজও তৈরি হয়নি। বই এবং তথ্যপ্রযুক্তি কেউ কারো পরিপন্থি নয় বরং সহায়ক। নিজেকে আরও বেশী অগ্রগামী করতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আবশ্যক। তবে মননশীল চেতনার জন্য বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা অনেক অনেক বেশি। বইয়ের জগৎ অনেক বিশাল। চিন্তাভাবনার বিস্তৃতি ঘটাতে বই পড়ুন। যদিও এটা পুরোপুরি সত্য নয় যে বর্তমানে তরুণরা মোটেই বই পড়েনা। অনেকে হয়তো বিনোদনভিত্তিক বই থেকে দূরে সরে গেছে কিন্তু আজও তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে বইয়ের কাছেই ফিরে যায়। সবশেষে একটি কথাই বলতে চাই ‘বই পড়ুন’। কারণ ভিজ্যুয়াল অনেক দৃশ্যই হয়তো কম্পিউটার বা টিভিতে আপনারা দেখেন। কিন্তু নিজস্ব মস্তিস্কের ভিজ্যুয়ালাইজেশন ক্ষমতা বাড়াতে বইয়ের বিকল্প নেই। হয়তো আপনি একটি উপন্যাস পড়লেন। এতে নিজের মতো যে দৃশ্যাবলী আপনি কল্পনা করে নিতে পারবেন টিভির পর্দায় তা হয়তো নাও পেতে পারেন। একথা সত্য যে বর্তমান তরুণরা আগের চেয়ে অনেকবেশী মেধাবী এবং প্রতিভাবান। কিন্তু তাদের মেধার চর্চা হচ্ছে ভিন্নপথে। বই পড়ার চর্চা কমে গেলে হয়তো জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে খুব বেশী অন্তরায় হয়ে দাড়াবেনা। তারপরেও নিজস্ব চিন্তা চেতনার বিস্তৃতি ঘটাতে একটু হলেও বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখুন। কারণ বই হচ্ছে তাই যা জ্ঞানের জগতের সাথে মনের জগতের সরাসরি যোগসূত্র ঘটায়।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply