২০০৪ সালে একটি ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। ২০০৫ সালের মার্চে ওই ছেলের এবং তার পরিবারের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে আমি একটি রেজিস্ট্রেশন ফরমে সই করি। তখন ছেলের পরিবারের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত ছিল কিন্তু আমার পক্ষে কেউ ছিল না। এর কিছুদিন পর থেকে ওই ছেলে স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। কয়েক বছর পর ওই ছেলে আবার আমাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে, কিন্তু এখন আমি তাকে ঘৃণা করি মনেপ্রাণে। আমি স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ি। যখন আমি রেজিস্ট্রি ফরমে স্বাক্ষর করি, তখন সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার বয়স ১৪ বছর ২ মাস, জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ীও তাই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমি ওই সময়ে যে সই করেছিলাম তাকে কি বিয়ে বলা হয় আইন অনুযায়ী? যদি বিয়েই হয়, তাহলে তা বাতিল করার জন্য কি তালাকনামা পাঠাতে হবে? পরিবার থেকে আমার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। আমি তালাকনামা পাঠিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন হয়ে বিয়ে করতে পারব? তবে ওই ছেলে স্বীকার করেছে রেজিস্ট্রেশনে যাদের নাম লিখা, তারা ভুয়া মানুষ। সই করার সময় তারা ছবি তুলেছিল, তা কি ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করবে?’
সামাজিক মর্যাদার কারণে আমি বা পরিবারের কেউই কোনো উকিলের সঙ্গে কথা বলিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই মানসিক দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
মিরপুর, ঢাকা
মুসলিম বিবাহ সম্পন্ন হয় মুসলিম শরিয়ত আইনে। শরিয়ত আইন অনুযায়ী যেকোনো সাবালক বা সাবালিকা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। শরিয়ত আইনের সঙ্গে বর্তমানে মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ ও মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪ বলবত্ আছে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ অনুযায়ী কেবল ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোনো মেয়ে এবং ২১ বছরের ঊর্ধ্বে যেকোনো ছেলে আইন অনুযায়ী বিবাহ চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে। এবং সে মোতাবেক নিবন্ধিত হতে পারে। সুতরাং, আপনার ১৪ বছর ২ মাস বয়সের নিবন্ধিত বিবাহ আইনসম্মত নয়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কোনো মেয়ে বিবাহ নিবন্ধন করার অধিকার রাখে না। যেহেতু শরিয়ত আইনের সঙ্গে প্রচলিত আইন বহাল আছে, সেহেতু এই ধরনের বিয়ে আইন অনুযায়ী সঠিক হয়নি। সুতরাং, আপনার বিবাহ অশুদ্ধভাবে নিবন্ধিত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার তালাক প্রদানের ক্ষমতা থাকলে তালাকের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেন। বৈবাহিক সম্পর্ক নিষ্পত্তির পরে আইনানুগভাবে আপনার দ্বিতীয় বিবাহে কোনো বাধা থাকবে না।
আমি যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি, তখন আমার আত্মীয়, মা, বাবা সবাই মিলে একজন দোজবরের কাছে আমাকে বিয়ে দেয়। ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। বিয়ের আগে বলেছিল, বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবে। ছেলের আগের বউ ছিল। সে ঢাকার মেয়ে। ছেলের আত্মীয়স্বজন সবাই ঢাকায় থাকে। মেয়েটার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে, তারপর আমাকে বিয়ে করেছে। বিয়ের ১৯ দিন পর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। আট মাস পর যখন আসে, তখন আমার সন্তান গর্ভে আসে। তার বোনেরা আমার সঙ্গে কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করে এবং সব কাজ আমাকে দিয়ে করায়। আমার স্বামী আমাকে বউ হিসেবে মূল্যায়ন করে না। বোনদের কথামতো চলে এবং সে এক মাস থাকার পর আবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। আমাদের বাড়ি থেকে কাউকে আসতে দেয় না। আমাকেও যেতে দেয় না। আমার হাতে কোনো টাকা-পয়সাও দেয় না। এখন সে দুই বা তিন বছর পরপর আসে বাংলাদেশে। দেশে এসেও আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। সে শুধু বোনদের কথামতো চলে। আমার একটা কন্যাসন্তান হয়। তার বোনেরা আমাকে ভয় দেখায়, আমার মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। তাদের খারাপ ব্যবহার সহ্য করে চোখের পানি ফেলি। এর মধ্যে লোকের মাধ্যমে জানি সে আবারও এক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছে। তার সন্তানও আছে। যখন আমি জানতে পারি, ওখানে বউ-বাচ্চা আছে, তখন আমার ননদেরা আরও বেশি অত্যাচার শুরু করে। এবার আমি বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসি। সেখানে আসার পর আমার এবং সন্তানের কোনো খোঁজখবর স্বামী নেয় না। মেয়েটাকে নিয়ে আমার চলতে খুব কষ্ট হয়। আমি একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। আমার সন্তান এখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। আমি দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করতে চাই না, মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। আমার বিয়ে হয়েছে ১২ বছর হলো। আমার স্বামীর সঙ্গে ছয় বছর ধরে দেখা হয় না এবং কোনো রকম ভরণপোষণ দেয় না। আমার স্বামী দাবি করে, সন্তানটাকে এসে আইনের মাধ্যমে নিয়ে যাবে। আইনের সাহায্য নিলে আমি সন্তানটাকে পাব কি না? এখন কী করতে পারি? আমি আর তার কাছে যেতে চাই না। এখনো আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি। যদি আইনের মাধ্যমে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাহলে কে সন্তানটাকে পাবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্যহারা না হয়ে সাহসের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। বৈবাহিক জীবনে নানা রকম অপবাদ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরেও আজ আপনি সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১-এর ৬ ধারা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের আরবিট্রেশন কাউন্সিলের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। বিনা অনুমতিতে বিবাহের শাস্তি হচ্ছে, এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কারাদণ্ড ও জরিমানা উভয়ই। মুসলিম আইনে সন্তানের আইনগত অভিভাবক হচ্ছেন পিতা। তবে একজন মা তাঁর কন্যাসন্তানকে তার বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত হেফাজতে রাখতে পারেন। মা হচ্ছেন সন্তানের হেফাজতকারী। সুতরাং, আইন অনুযায়ী আপনি আপনার কন্যাসন্তানকে তার বিয়ের আগ পর্যন্ত আপনার কাছে রাখতে পারেন। যেহেতু আপনি বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই হেতু বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিবাহের বিরুদ্ধে মামলা না করে দেনমোহর ও সন্তানের ভরণপোষণের মামলা করতে পারেন। এ ছাড়া আমি আশা করি, আপনি মেয়েকে কাছে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার ভবিষ্যেক প্রাধান্য দেবেন। সে ক্ষেত্রে আবেগের বশবর্তী না হয়ে আপনাকে বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার ও আপনার কন্যার সাফল্যময় জীবন কামনা করছি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নাহিদ মাহতাব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৪, ২০০৯
Leave a Reply