সমস্যা: আমার পরিবার খুব দরিদ্র। উনি তমা (ছদ্মনাম)। তাঁর স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আমরা একই জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকি প্রায় দুই বছর। যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা একে অন্যের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ছিলাম। টাকা-পয়সা লেনদেন, খাওয়াদাওয়া, একসঙ্গে বেড়ানো—সবই ছিল ভাইবোনের মতো। কিন্তু প্রায় এক বছর হলো সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। আমি ওই আপুর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারিনি। উনি আমাকে এত বেশি ভালোবাসেন, যা কাউকে বোঝানো যাবে না। কিন্তু আমার মা-বাবা, ভাইবোন—সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, কবে একটি ভালো চাকরি করব। প্রতিজ্ঞা করি ভালো হয়ে যাব, তাঁর কাছে গেলে সব ওলটপালট হয়ে যায়। তাঁর স্বামী আমাকে এতটা বিশ্বাস, ভক্তি ও শ্রদ্ধা করেন, যা ভাবলে নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণা হয়; উনি বলেন, ‘আমি আপনার ঘর করতে চাই না, শুধু ভালোবাসা চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
বিএম কলেজ, বরিশাল
পরামর্শ: আমাদের প্রতিটি সম্পর্কের একটি সংজ্ঞা থাকা প্রয়োজন। একইভাবে আমাদের আচরণ ও চিন্তাধারাতেও কিছু আদর্শ মেনে চলার বিষয় থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, আমরা ভাই-বোন, মা-মেয়ে, মা-ছেলে এই ধরনের সম্পর্কগুলো পরিবারের বাইরে তৈরি করি। কিন্তু সেগুলো জন্মসূত্রে হয় না বলে সেখানে সীমারেখা টানতে ব্যর্থ হই এবং মেলামেশার ক্ষেত্রেও কোনোরকম দূরত্ব রক্ষা করা হয় না। তোমার পরিবারে যেহেতু আর্থিক সংকট রয়েছে, তোমাকে হয়তো অনেক কষ্ট করে এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে। তোমার পরিবারও তোমার ওপর নির্ভরশীল। আমার ধারণা, এসব কারণে তুমি আগে থেকেই মানসিক চাপের মধ্যে ছিলে এবং বর্তমান পরিস্থিতি তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সে কারণেই তোমার সমস্যাগুলো শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় তোমাদের দুজনের ভাই-বোনের সম্পর্ক ধরে রাখা আর সম্ভব হবে না, কারণ সেটা শুধু লোক দেখানো সম্পর্ক হবে। মেয়েটি কি সত্যিই তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী? যদি সে তোমার ভালো চায়, তাহলে সে নিজের পরিবারে সবকিছু ঠিকঠাক রেখে তোমার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক কেন রাখছে তা কি ভেবে দেখেছ? একদিকে তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে বলছে আর অন্যদিকে তোমার ভালোবাসা চেয়ে তোমার চলার গতি রুদ্ধ করাটা কি ঠিক হচ্ছে? তুমি শুধু নিজেকে দোষারোপ করে কষ্ট পাচ্ছ। এই সমাজবহির্ভূত সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে কিন্তু মেয়েটিরও অর্ধেক দায়িত্ব রয়েছে। একই সঙ্গে সে কিন্তু তার স্বামী-সন্তানের প্রতিও অবিচার করছে। তোমাদের এই সম্পর্কের যেহেতু কোনো ভবিষ্যত্ নেই, তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এভাবে মেয়েটির সঙ্গে তুমি মেলামেশা করতে থাকবে কি না। তোমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। কাজেই যা ঘটেছে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তোমরা দুজনই ঠিক করে নাও কীভাবে ভালোভাবে নিজেকে শ্রদ্ধা করে বেঁচে থাকা যায়। এ ধরনের সম্পর্কগুলো যে আমাদের জীবনে শুধুই জটিলতা বাড়ায় এবং নৈতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য, সেটা তোমাদের দুজনকেই খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে।
সমস্যা: দেড় বছর ধরে একটি ছেলেকে ভালোবাসি। সাত-আট মাস আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। নতুন বন্ধুটির সঙ্গে আমি আমার প্রেমিকের চেয়ে অনেক বেশি মিশতে শুরু করি। এতে ওর প্রতি একটা আবছা ভালোলাগা তৈরি হয়। হঠাত্ একদিন ও আমাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়। ও জানত, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি; তবু। যাকে ভালোবাসি সে ছিল মাদকাসক্ত। তাকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলাম। আমি ওকে কেবল বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও খুব উত্পাত শুরু করলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। এতে ও আরও খেপে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে। এমনকি আমাদের কথা বাসায় জানিয়ে দিয়েছে।
আদ্রিতা
চট্টগ্রাম।
পরামর্শ: যে ছেলেকে তুমি দেড় বছর ধরে ভালোবাস বলে লিখেছ, তাকে তুমি সত্যিই ভালোবেসেছ কি না সেটা নিজের মনকে ভালো করে প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা কর। ছেলেটি যেহেতু মাদকাসক্ত, তার প্রথম ভালোবাসার বস্তু মাদক সে নিয়ে নিয়েছে। কাজেই, ছেলেটি তোমাকে কতটা আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে একজন মনের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেখানেও প্রশ্ন রয়ে যায়। আমাদের দেশের অনেক মেয়েই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে মাদকাসক্ত ছেলেদের সাহায্য করার জন্য নিজেদের ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব দিতে চায়। কিন্তু দেখা যায় ছেলেটি অনেকবার প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। এতে মেয়েটিও একসময় ক্লান্ত হয়ে অন্য কারো সঙ্গ বা আশ্রয় খুঁজতে থাকে। তোমার ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু হয়েছে কি না একটু ভেবে দেখবে। অন্য ছেলেটিকে তুমি বন্ধু বলে ডাকছ ঠিকই, তবে তার সঙ্গে তোমার মেলামেশার মাত্রাটা শুধু বন্ধুর মতো ছিল কি না সে ব্যাপারটিও বোঝা দরকার। তুমি যখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলে, সে তোমাকে প্রেমিকা হিসেবে দেখতে শুরু করেছে, তখন যদি তাকে পরিষ্কারভাবে তোমার অবস্থান জানিয়েদিলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। আশা করি, তুমি এ তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে চলার পথে ব্যবহার করবে। দ্বিতীয় ছেলেটি তোমাকে হুমকি দিচ্ছে বলে কি ভয় পাচ্ছ? আশা করি, এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে ভয় দেখিয়ে আর যা-ই পাওয়া যাক, ভালোবাসার মতো অমূল্য জিনিস পাওয়া যায় না। সম্ভব হলে তুমি তাকে সরাসরি বল, তোমার প্রতি ওর যদি কিছুটা হলেও শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তাহলে সে যেন এ ধরনের অস্ত্র প্রয়োগ না করে। অন্তত তোমাদের এক সময়ের সুন্দর বন্ধুত্বের কথা মাথায় রেখে ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি না করে, তাহলে তুমি খুব খুশি হবে, এ কথা জানিয়ে দাও। এ ছাড়া এ পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে তোমার যেটুকু অবদান রয়েছে, ওই দায়িত্বটুকু পুরোপুরি মাথায় নিয়ে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা কর, ভবিষ্যতে কোনো সম্পর্ক তৈরি হলে দুজনই সেই সম্পর্কের ধরন সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকবে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩১, ২০০৯
Leave a Reply