‘আমার দিনগুলো ছিল গুমোট। আর রাতগুলো ছিল নীরব। নিজের খুব আপন জেনে যে স্বপ্নগুলোকে এতদিন লালন করে এসেছি সেগুলোকে হঠাৎ করেই খুব অচেনা বলে মনে হচ্ছিল। রাত জাগা ভোরে কানপেতে আমি শুধু ভাঙ্গনের শব্দই শুনেছি। হয়তো আমার, ওর কিংবা আমাদেরও ছিল অনেক অভিমান। সেই অভিমানের প্রকাশ কিংবা ঝোঁকের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো হয়তো সবসময় ঠিকও ছিল না। কিন্তু ঝড়ের পরের এক রাতে ওর জানিয়ে দেয়া কথাগুলো যে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের দেয়ালটাকে ভেঙ্গে দেবে এমনটাই কি জানা ছিল?’- ডায়েরির পাতা জুড়ে কথাগুলো লিখতে লিখতে একসময় নিজের অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে শ্রাবন্তীর। আজ ৩ মাস ১৮ দিন হলো আকাশের সাথে তার বিবাহিত সম্পর্কের ইতি ঘটেছে। অথচ এই ক’দিনেও পুরোপুরি ভুলে থাকা যায়নি ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলোকে। কিংবা বলা চলে পারপার্শ্বিক সময় আর পরিবেশ চাইলেও ফেলে আসা দিনগুলোকে অতীত হতে দেয়নি। হয়তো এ কারণেই আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের কোনো আড্ডায়, নিমন্ত্রণে এখন আর যেতে ইচ্ছে করে না শ্রাবন্তীর। ইচ্ছে করে না কাছের মানুষদের অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতেও। তার উপর ডিভোর্সের পরের এই সময়টায় নিজের চেনা বাবা-মা আর ভাই-বোনকেও কেমন যেন অচেনা বলে মনে হতে থাকে শ্রাবন্তীর। মা এখনো মনে করেন, শ্রাবন্তী আরেকটু সহনশীল হলেই নাকি টিকিয়ে রাখা যেতো সম্পর্কটাকে। তাহলে আকাশ এর কি কোনো দোষই ছিল না! আর ঘটনা যেভাবে যাই ঘটুক না কেন হঠাৎ একা হয়ে যাবার চাপটা কেন বইতে হবে শুধু শ্রাবন্তীকেই!
আসলে নানা কারণে আমাদের সমাজে যারা দোকলা থেকে একলা হয়ে পড়েন তাদের প্রায় প্রতিনিয়তই মুখোমুখি হতে হয় একা থাকার যন্ত্রণার সাথে। একদিকে দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে একা হয়ে যাবার দুঃখবোধ আর অন্যদিকে পরিবার ও বন্ধুদের নানা কৌতুহল তখন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া মানুষগুলোকে। আর এই ভাঙ্গনের সময়টায় আত্মবিশ্বাসের সাথে সবকিছু মোকাবেলা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একথা হয়তো সত্য যে, সম্পর্কের মাঝে ভাঙ্গনের সূত্রপাত কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না। তবে কাঙ্খিত সম্পর্কের মাঝেও যখন অনাকাঙ্খিত কোনো কারণে দেখা দেয় ভাঙ্গন, তখন সেই ভাঙ্গনকেও মেনে নিতে হয়। আর মেনে নেয়া, মনে নেয়ার এই বিষয়টির শুরু হতে হবে পরিবার ও পারপার্শ্বিকের মাঝে থেকেই।
এই পৃথিবীতে যত নারী-পুরুষ প্রতিনিয়ত বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে একা হয়ে পড়ছেন তাদের সবার একা হবার গল্পটি হয়তো একরকম নয়। তবে নেপথ্যের কারণ যাই হোক না কেন, জীবনকে একমুখী কিংবা এককেন্দ্রীক করে না দেখে সবসময়ই তাকাতে হবে সামনের দিকে। ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছেয়, যে সম্পর্ক চুকে গেছে সেই সম্পর্ক নিয়ে হতাশায় ভোগার কোনো মানে হয় না। কাজেই যে সময়টায় সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা যেত সেই সময়ের পরে এসে সম্পর্কের ভাল-মন্দ নিয়ে ভাববারও কোনো মানে হয় না। বরং আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং নিজের যুক্তিগুলোকে ভালোবেসেই আপনাকে তাকাতে হবে সামনের দিকে।
বিয়ের সম্পর্ক চুকে যাওয়ার পরে অনেকেই একটা সময় জুড়ে বাড়তি বিষণ্নতায় ভোগেন। এ সময় স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রতিও অনেকের মনে জন্ম নেয় অনাগ্রহ। তবে সম্পর্কের ভাঙ্গন যেন আপনাকে জীবনের মহাসড়ক আর ব্যক্তিজীবনের লক্ষ্য থেকে আপনাকে দূরে ঠেলে না দেয় সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে আপনাকেই। মনে রাখবেন, জীবন থেকে কখনো পালিয়ে বাঁচা যায় না। বরং সত্যের মুখোমুখি হয়ে আর সবাইকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয় জীবনের চলার পথে। ডিভোর্সের পর যদি আত্মীয় বা বন্ধুরা আপনাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে বা কিছু জানতে চায় তাহলে বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে তাদেরকে যথাসম্ভব জানান। অহেতুক বিব্রত না হয়ে পুরো বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে আর ঠান্ডা মাথায় মোকাবেলা করার চেষ্টা করুন। সেই সাথে সারাক্ষণ ফেলে আসা সময়ের ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত না রেখে জীবনটাকে যথাসম্ভব উপভোগ করাটাও এই সময়ের একাকীত্ব কাটিয়ে তোলার জন্য জরুরী।
দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততার পর যারা হঠাৎ করেই একা হয়ে পড়েন তাদের মাঝে স্বভাবতই জন্ম নেয় নানা অভিমান। তবে এই অভিমান থেকে নিজেকে দূরে রেখে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামনের দিকে তাকানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া কি করলে কি হতো কিংবা কি করা উচিত ছিল ইত্যকার ভাবনা থেকে অন্যকে দোষারোপ করার পরিবর্তে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারাটাই এই সময়ে আপনার জন্য মঙ্গলজনক।
সম্পর্ক চুকে যাওয়ার পর একাকীত্ব যেন আপনাকে পেয়ে বসতে না পারে সেজন্য সংসার কিংবা সংসারের বাইরের কাজেও নিজেকে মনোযোগী করে তুলুন। যদি আপনি কর্মজীবী নারী বা পুরুষ হন তাহলে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। অন্যদিকে নেহাত ঘরে বসে যারা একাকীত্বের যন্ত্রণায় ভুগছেন তারাও নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন পরিবারের নানা কাজে। সর্বোপরি, সম্পর্ক চুকে যাওয়ার গুমোটভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বন্ধু এবং আত্মীয়দের মাঝেই খুঁজে নিন আপনার বেঁচে থাকার রসদ। আর যদি আপনার বিচ্ছিন্ন জীবনে সঙ্গী হিসেবে থাকে ভালোবাসার সন্তান, তাহলে তো সবকিছু ভুলে এই সন্তানকে আঁকড়ে ধরেই তুচ্ছজ্ঞান করা যায় সকল একাকীত্ব আর বিষণ্নতাকে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর ২৭, ২০০৯
Leave a Reply