শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে যক্ষ্মা একটি ভীতিকর রোগ। যক্ষ্মা রোগীর একটি চিত্র কল্পনা করলেই মনের মানস পর্দায় ভেসে ওঠে একটি ছবি, সেটি হলো-একজন রোগী অনবরত কাশছেন, পরক্ষণেই শুরু হয়ে যায় কাশির সঙ্গে গলগল করে রক্ত যাওয়া। এমন ধরনের অনেক চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কাজী নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অথবা পুরনো দিনের ছায়াছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’সহ অনেক গল্পে। ফুসফুসের যক্ষ্মা হলে কাশির সঙ্গে রক্তও যেতে পারে , আবার নাও যেতে পারে। তবে কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়াকে আমি রোগীর জন্য আশীর্বাদ মনে করি। কারণ কফ-কাশি আর জ্বরে জ্বরে শীর্ণ হয়ে গেলেও যতক্ষণ পর্যন্ত কাশির সঙ্গে রক্ত না যাচ্ছে, ততক্ষণ রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। আবার আমরাও অনেক ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের পর এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ এবং পরিবর্তন করতে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে নিয়ম হলো, বাংলাদেশে তিন সপ্তাহের বেশি কাশি বা দুই সপ্তাহের বেশি জ্বর চলতে থাকলে যক্ষ্মার কথা সন্দেহ করা উচিত, যদি অন্যান্য এন্টিবায়োটিক কাজ না দেয়। আর এই সন্দেহ খুবই প্রয়োজন; কারণ এই সন্দেহই চিকিৎসককে দেবে রোগ নির্ণয়ের সঠিক ঠিকানা। ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে কাশির সঙ্গে রক্ত যায় এটা যেমন ঠিক, তেমনি আবার যক্ষ্মা ছাড়া ফুসফুসের অন্যান্য রোগেও কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে পারে, যেমন- ব্রংকিএকটেসিস, ফুসফুসে ফোঁড়া, ফুসফুসের ক্যাসার, নিউমোনিয়া ইত্যাদি। ফুসফুস ছাড়াও কিছু হৃদরোগ আছে, যেমন-মাইট্রাল ভাল্ব সরু হয়ে গেলেও কাশির সঙ্গে রক্তপাত হতে পারে। এই ক’টি প্রধান কারণ ছাড়াও অনেক কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে যেহেতু বাংলাদেশে যক্ষ্মা একটি অন্যতম প্রধান স্বাস্হ্য সমস্যা, তাই যক্ষ্মার ব্যাপারে সন্দেহ অবশ্যই চিকিৎসককে গুরুত্বে আনতে হবে।
ব্রংকিএকটেসিস ফুসফুসের শ্বাসনালীর একটি রোগ। ব্রংকাইটিস নামের সঙ্গে কমবেশি আমরা অনেকেই পরিচিত, যদিও ব্রংকিএকটেসিস নামটা একটু জটিল হওয়ায় এই রোগটির নাম অনেকেই শোনেননি। ব্রংকিএকটেসিস হলে ফুসফুসের বিশেষ অংশের শ্বাসনালীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো নষ্ট হয়ে স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বেশি ফুলে ওঠে। তার ফলে সেগুলো আর কার্যক্ষম থাকে না। এই রোগের অনেক কারণ রয়েছে, যেমন-ছোটবেলায় হুপিং কাশি, নিউমোনিয়া, হাম বা যক্ষ্মা হলে সেগুলো যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে তার জটিলতায় এই ব্রংকিএকটেসিস দেখা দিতে পারে। অনেকেই হামকে মামুলি রোগ মনে করে গুরুত্ব দেন না, বরং অপচিকিৎসা করিয়ে থাকেন। হাম, নিউমোনিয়া, হুপিং কাশ দেখা দিলে তার সুষ্ঠু সুন্দর এবং বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার প্রয়োজন। এই রোগ দেখা দিলে রোগীর কাশির সঙ্গে প্রচুর রক্তপাত হতে পারে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর ও প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত হলুদ পাকা কফ যা কিনা সকালে বেশি দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে লক্ষণগুলো যক্ষ্মার মতোই হয়ে থাকে। ব্রংকোগ্রাম করে এই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। একজন যক্ষ্মা রোগী পুর্ণ চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও তার কাশির সঙ্গে কিছু রক্ত যেতে পারে। কারণ যক্ষ্মার ক্ষত সেরে যাওয়ার পর সেখানে ব্রংকিএকটেসিস তৈরি হতে পারে। কফে রক্ত যাওয়ার ফলে আমাদের দেশে প্রচুরসংখ্যক রোগী এ কারণে মাসের পর মাস যক্ষ্মা রোগের ওষুধ খেয়ে চলেছেন অথচ যার হয়তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া ফুসফুসে ফোঁড়া দেখা দিলেও রোগীর জ্বর থাকে, পাকা হলুদ কফ এর এবং কফের সঙ্গে রক্ত দেখা দেয়। সেক্ষেত্রেও রোগীকে অনেক সময় যক্ষ্মা রোগের ওষুধ খাওয়ানো হয় যক্ষ্মা ভেবে। যদিও আমার কাছে কোনো জরিপ নেই, তবু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশে প্রচুরসংখ্যক রোগী অনেকটা অকারণে শুধু কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়ার জন্যই যক্ষ্মা রোগের ওষুধ খাচ্ছেন।
যদিও যক্ষ্মা এবং ক্যাসার রোগীর উভয়ের কাশির সঙ্গে রক্ত যায়, তবু রক্ত যাওয়ার মধ্যে এই দুই রোগে কিছু পার্থক্য রয়েছে। একজন যক্ষ্মা রোগীর কাশির সঙ্গে হঠাৎ প্রচুর রক্ত যায়, অপরদিকে ফুসফুসের ক্যাসারে কাশির সঙ্গে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এবং অল্প অল্প রক্ত যায়। ক্যাসারের রোগীর প্রচুর পরিমাণে ধুমপানের ইতিহাস থাকে। অর্থাৎ ধুমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যাসারের সম্পর্ক খুবই নিবিড়, তবে যক্ষ্মার সঙ্গে ধুমপানের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই বলে আমার বিশ্বাস। কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া প্রতিটি রোগীরই কমপক্ষে তিনটি কফ পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে এবং তাতে যক্ষ্মা জীবাণু আছে কিনা, কারণ যদি কফে যক্ষ্মা জীবাণু ধরা পড়ে, তাহলে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে এটাই সর্বোত্তম প্রমাণ।
একজন বয়স্ক ব্যক্তি যদি বেশ কিছুদিন ধরে কাশতে থাকেন, বুকে তার তীব্র ব্যথা থাকে, স্বর বসে যায় এবং কফের সঙ্গে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রক্ত যায় তবে এক মুহুর্ত দেরি না করে একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ এগুলো হলো ক্যাসারের উপসর্গ। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এমনকি ব্রংকোসকোপির মাধ্যমে নির্ণয় করবেন সত্যিই রোগী ফুসফুসের ক্যাসারে ভুগছেন কিনা। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও রক্ত যাওয়ার কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না
—————————
ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
আমার দেশ, ৩ জুন ২০০৮
Leave a Reply