মা-খালাদের সঙ্গে রোদে বসে আচার পাহারা দেওয়া, চুরি করে আচার খেতে গিয়ে কানমলা খাওয়া, ঘরের তাক থেকে আচারের বয়াম নামাতে গিয়ে পিছলে পড়া—এ সবই বাঙালির শৈশবের স্মৃতি। যুগ যুগ ধরে মা-খালারা আচার বানিয়ে আসছেন; সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন ভালোবাসা ও মমতা। এর মূল্য পরিশোধ করার নয়; তবে স্বীকৃতি তো দেওয়া যায়! সে চেষ্টা থেকেই আয়োজন করা হচ্ছে প্রাণ-প্রথম আলো জাতীয় আচার প্রতিযোগিতা। এর দশম বছর পূর্তি হলো এবার। এ উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মূল মিলনায়তনও সেজেছিল নতুন সাজে।
কে পাচ্ছেন বর্ষসেরা আচার প্রতিযোগিতার পুরস্কার! শুরু থেকেই যেন প্রশ্নটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল সবার মনে। লাখ টাকার পুরস্কার বলে কথা। এটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত। ধৈর্যের যেন বাঁধ মানছিল না দর্শকদের। শেষমেশ ঘোষণা করা হলো বিজয়ী ঢাকার গওহর আফজার নাম। তিনি মঞ্চে উঠলেও শেষ হলো না হাততালি পর্ব; শব্দটা বরং আরও বাড়ল যখন তিনি জানালেন, পুরস্কারের টাকা দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন।
চূড়ান্ত পর্বে বাছাই হওয়া ৪৮টি আচারের মধ্য থেকে সেরা নির্বাচিত হলেন গওহর আফজা। সারা দেশ থেকে জমা পড়েছিল প্রায় সাত হাজার আচার; এর মধ্য থেকে দুই হাজার আচার বাছাই করা হয় প্রাথমিকভাবে। বাছাইয়ের কাজটি চলে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের তত্ত্বাবধানে। পরে ৪৮টি আচার মূল পর্বের বিচারকদের পরখ করতে দেওয়া হয়।
প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীনের উপস্থাপনায় শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচার বানাতে কী লাগে? তেল, মসলা, আম, জলপাই—নানা উত্তর ভেসে এল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটার কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনিই; সেটা হলো—মমতা।
আমাদের দেশের নিজস্ব ঐতিহ্য এ আচারকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও পৌঁছে দেওয়ার আশা ব্যক্ত করলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আমজাদ খান চৌধুরী।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক উজমা চৌধুরী জানালেন প্রতিযোগিতার নানান তথ্য।সারা দেশ থেকে সাত হাজার আচার জমা পড়েছিল চারটা বিভাগে। প্রথমে ২,২০০, পরে সেগুলো থেকে চূড়ান্ত পর্বে আসে ৪৮টি আচার।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, ‘আচার বানানোর স্বীকৃতি হিসেবে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান যে নারীদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায় এতে তাঁদের বিপুল অংশগ্রহণ দেখে।’
অনুষ্ঠান শুরুর আগে—প্রধান অতিথি তখনো মিলনায়তনে ঢোকেননি; তবে বাদ্যযন্ত্রের বাজনা শুনেই বোঝা গেল কে আসছেন। বাজছিল সেই চেনা সুর—‘শিল্পী, আমি তোমাদেরই গান শোনাব…’। প্রধান অতিথি ছিলেন কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। তিনি বসলেন তাঁর আসনে। দর্শকসারির মধ্য থেকে ঢাক-ঢোলবাজাতে বাজাতে ঢুকে পড়লেন ক্লিন বাংলাদেশের চার ঢুলি।তাদের বাজনা থামতেই সুর বেজে উঠল —‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল…।শুরু হলো সেই গানের সঙ্গে নাচ।একদল নৃত্যশিল্পী যেন আরও জোরালো করে তুললেন দেশের ঐতিহ্যকে বড় পরিসরে তুলে ধরার দাবি। নাচটির পরিকল্পনা করেছেন সামিনা হোসেন প্রেমা ও ওয়ার্দা রিহাব। তাঁদের নেতৃত্বেই দলগত নাচটি পরিবেশন করলভাবনা।
শুটিং স্থগিত রেখে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। মঞ্চে এসে গাইলেন মনপুরা চলচ্চিত্রের ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছিবন্ধুরে…’ গানটি। এরপর দুই বোন, পরপর—সামিনা চৌধুরী ও ফাহমিদা নবী। সামিনা গাইলেন ‘আমার মাঝে নেই এখন আমি…’ আর ফাহমিদা ধরলেন ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প…’ গানটি।
এরপর মঞ্চে এলেন চূড়ান্ত পর্বের বিচারকেরা। এত আচার খেয়ে দেখার সুযোগ পাওয়ার কারণে অনেকে ভাবতে পারে, বিচারকদের বোধহয় দারুণ মজা! মডেল ও অভিনয়শিল্পী বাঁধন সেই ভুল ভাঙাতে চাইলেন। এর চেয়ে নাকি মডেলিং করা অনেক সহজ। ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী তাহসিনা শাহীনের অনেক দিনের ভুল ধারণা ভেঙে গেছে বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আগে ভাবতাম, আমার মা-ই সবচেয়ে ভালো আচার বানান; এখানে এসে দেখি, মায়ের মতো ভালো আচার বানান অনেকেই।’
আচার বানান মেয়েরা; কিন্তু তাঁদের সেই কাজে পরিবারের অন্যদেরও সহযোগিতা থাকে। বাড়ির পুরুষ সদস্যরাও সাহায্য করেন তাঁদের কাজে। চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান উপস্থাপক ফারজানা ব্রাউনিয়া তাই আহ্বান জানালেন, পুরুষদের উদ্দেশেও হাততালি দিতে। আরেক বিচারক সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা খালি গলাতেই গেয়ে শোনালেন—‘বাপুই চেংড়া রে গাছত উঠিয়া…’। রুনা লায়লার সামনে তাঁর গাওয়া একটি গানের দুই লাইন গেয়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে কণ্ঠশিল্পী পুতুলকে মঞ্চে একটা যেন পরীক্ষাই দিতে হলো! রুনা লায়লার হাসিমুখ দেখে মনে হলো পুতুল ভালোভাবেই উতরে গেছেন।
রুনা লায়লার গাওয়া ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’ গানটির সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছিল দলীয় নৃত্য। মঞ্চে হঠাত্ চমক। টকটকে লাল শাড়ি পরে এলেন অভিনয়শিল্পী রোজিনা। কসাই ছবিতে এ গানের সঙ্গে তিনি অভিনয় করেছিলেন। পুরোনো সেই দিনেই যেন নিয়ে গেলেন তিনি দর্শকদের।
নতুন প্রজন্মের তিন শিল্পী এবার রুনা লায়লার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর গাওয়া তিনটি গান গেয়ে। চম্পা বণিক গাইলেন ‘যখন থামবে কোলাহল…।’ ঝিলিক শোনালেন ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে’। আর পুতুলের গলায় শোনা গেল ‘শিল্পী, আমি তোমাদেরই গান শোনাব’। এরপর একসঙ্গে তাঁরা গাইলেন ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যরাগে…’ গানটি। গানটি শেষ করে তিন শিল্পী একসঙ্গে নেমে গেলেন মঞ্চ থেকে। গিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন রুনা লায়লাকে। তাঁদের হাত ধরেই পুরস্কার বিতরণ করতে মঞ্চে এলেন রুনা লায়লা।
ঢাকার বাইরের নানা এলাকা থেকেও প্রতিযোগীরা এসেছেন। প্রায় সবার সঙ্গেই আছেন স্বামী, ছেলেমেয়ে, ছেলের বউ। একজনের অর্জনের আনন্দ ভাগ করে নিতে এসেছেন পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য। স্বামী ছুটি না পাওয়ায় খুলনা থেকে আসতে পারেননি টক বিভাগের প্রথম পুরস্কার বিজয়ী ইভা কবির। তাঁর হয়ে পুরস্কার নেন ছেলে।
ছেলের বউকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মিষ্টি বিভাগের দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী বেগম মাহমুদা রুবাইয়া। তিনি প্রিয় শিল্পী রুনা লায়লার জন্য বানিয়ে নিয়ে এসেছেন এক বয়াম আচার।
ঝাল বিভাগের প্রথম পুরস্কার বিজয়ী জেবুন্নেসা পুরস্কার নিতে মঞ্চে আসার সময় মনে হচ্ছিল, অন্য কারও হয়ে পুরস্কার নিতে আসছেন।
এত কম বয়সের এমন আধুনিক মেয়েরা আবার আচারও বানায়! উপস্থাপকের দারুণ বিস্ময়। এখনকার মেয়েরা রাঁধতে পারে না—এমন বদনাম অনেকটাই ঘুচিয়ে দিলেন জেবুন্নেসা।
সেরা বিজয়ীর জন্য এক লাখ টাকা ছাড়া অন্যদের জন্য পুরস্কার হিসেবে ছিল ৫০ হাজার টাকা, ডিপ ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ও এলসিডি মনিটর; আর সান্ত্বনা পুরস্কার বিজয়ীদের জন্য ছিল তৈজসপত্র।
এই পুরো আয়োজনের মিডিয়া সহযোগী ছিল চ্যানেল আই।
রুহিনা তাসকিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৭, ২০০৯
Leave a Reply