আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যত্। একদিন এই ছোট্ট শিশুরাই বড় হবে, হবে জাতির কর্ণধার। ফুলের নতুন কুঁড়ির মতোই কোমল এই শিশুদের মন। তারাও কল্পনা করতে পারে, দেখতে পারে স্বপ্নও। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বা কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে দায়িত্ব নিতে হয় শিশুর অভিভাবক বা মা-বাবাকেই। কারণ, শিশুরা বড় বেশি অনুকরণপ্রিয়। ছোটবেলা থেকে তাদের যে পরিবেশে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, তারা সেভাবেই শিখতে শুরু করে। এভাবেই গড়ে ওঠে তাদের মানসিক বিকাশ।
কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের লিঙ্গবৈষম্যের শিক্ষা দেওয়া হয়। শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অভিভাবকেরা শিশুকে এই শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আর এতে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চিনতে শুরু করে। বুঝতে শেখে ছেলে-মেয়ের পার্থক্য। কারণ, ছোটবেলা থেকেই অভিভাবকেরা শিশুদের হাতে আলাদা আলাদা খেলনা তুলে দেন। যেমন ছেলেদের জন্য গাড়ি, পিস্তল, উড়োজাহাজ আর মেয়েদের জন্য পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি। যদি একজন আরেকজনেরটা নিয়ে খেলতে চায়, তাহলে বাধা দেওয়া হয়— সেটা তার জন্য নয়। এতে ছেলেরা শিখে নেয়, তারা বড় হয়ে গাড়ি চালাবে, অস্ত্র ব্যবহার করবে। মেয়েরা পুতুল খেলা আর হাঁড়ি-পাতিল খেলার মাধ্যমে শিখে নেয়, বড় হয়ে সন্তান লালন-পালন ও রান্নাবান্না করাই যেন তাদের একমাত্র কাজ। ছোটবেলা থেকে এসব শিখতে শিখতে শিশুরা সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হয়, যার প্রভাব সমাজ থেকে শুরু করে পুরো পরিবেশের ওপর পড়ে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, শিশুরা একটু বড় হতেই হরমোনের কারণে বুঝতে শেখে—তারা ছেলে, না মেয়ে। এটা প্রাকৃতিক একটা বিষয়। কিন্তু তাদের এই পার্থক্য বোঝাটা অনেকটাই সামাজিক কারণেও ঘটে থাকে। সমাজ কর্তৃক আরোপিত কিছু বিধিনিষেধের কারণে এমনটা হয়। যেমন শিশুদের খেলনা দিয়ে আমরা ছোট্ট থেকেই তাদের বুঝিয়ে দিই, কোনটা ছেলেদের খেলনা আর কোনটা মেয়েদের। এতে শিশুরা একমুখী হয়ে ওঠে। আর এই একমুখী হওয়ার কারণে ছেলে শিশুদের একটু বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মেয়ে শিশুরাও বড় হয়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাইরের কাজের দিকে যেতে ভয় পায়, যা সমাজের জন্য মোটেও কাম্য নয়। তাই শিশুদের হরমোনগত পার্থক্যগুলো স্বীকার করে খেলনা থেকে শুরু করে শিক্ষা পর্যন্ত সব কিছুতেই বৈষম্যহীনতার শিক্ষা দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুব মোতানব্বি বলেন, আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্টের (ইসিডি) ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুদের ছোটবেলায় আমরা যা শেখাই, তারা তা-ই শেখে এবং তার প্রভাব সেই শিশুটির পুরো জীবনের ওপর পড়ে। আর খেলনা দিয়ে অভিভাবকেরা যে বৈষম্য বা আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তার ফলে শিশুদের মনে একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং তাদের মনে সব সময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে। এতে তাদের সামাজিকীকরণটা পরিপূর্ণভাবে ঘটে না।
অভিভাবকদের করণীয়
শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে লিঙ্গবৈষম্যসহ যেকোনো ধরনের বৈষম্য একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। আর এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে অভিভাবকদেরই সচেতন হতে হবে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের যা করণীয়:
ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
শুধু ছেলেরাই বাইরের কাজ এবং মেয়েরা ঘরকন্নার কাজ করবে, এমন ধারণা পরিহার করতে হবে।
ছেলে ও মেয়ে উভয় শিশুকেই একই ধরনের খেলনা দিয়ে খেলতে দিতে হবে। তাহলে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার বিষয়টি শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে শিখবে।
মেয়ে শিশুদের প্রাকৃতিক বিষয়গুলো মেনে নিয়ে তাদের ছেলেদের সমকক্ষ ভাবতে হবে।
শিশুদের খেলাধুলা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও পুরো জীবনে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুদের এমন খেলনা দেওয়া যাবে না, যা পরবর্তী সময়ে তাদের বিপথগামী করতে পারে।
শিশুদের একই ধরনের খেলনা ও শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখেও কিছু খেলনা দিতে হবে।
সর্বোপরি সবাইকে ভাবতে হবে, একটি ছেলে শিশু যা পারে, সঠিক পরিচর্যা নিলে একটি মেয়ে শিশুকে দিয়েও সেই কাজ করানো সম্ভব। তাহলেই সমাজ থেকে দূর হবে লিঙ্গবৈষম্যের শেকড়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৭, ২০০৯
Leave a Reply