সমস্যা: আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবা কিছুটা অস্বাভাবিক ধরনের। ছোটবেলায় তিনি আমাকে রাতদুপুরে ঘুম থেকে উঠিয়ে প্যারেড করাতেন। মাকে শারীরিক ও মানুষিকভাবে প্রচুর নির্যাতন করতেন। আমি তাঁর (বাবা) ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত এবং মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি।
ছোটবেলা থেকেই অনেকের কাছে মেধাবী হিসেবে প্রশংসা পেতাম। যদিও পড়াশোনা বা পরীক্ষার ফলাফলে কখনোই এর কোনো প্রকাশ ছিল না। আমারও নিজেকে মেধাবী মনে হতো এত দিন। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে, আমার মধ্যে মেধার চরম দৈন্য রয়েছে। আমার পড়ার অভ্যাস বেশ ভালো। সমস্যা হলো প্রতিযোগিতামূলক বা ফলাফলকেন্দ্রিক পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ পাই না (আগেও পাইনি)।
খালিদ আজমল
পরামর্শ: তোমার মেধার দৈন্য আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যারা পরীক্ষায় অনেক নম্বর পায়, তারা সবাই যে খুব বেশি মেধাবী তা নয়। অনেকেই শুধু মুখস্থ করে, বিষয়বস্তু না বুঝে পরীক্ষার খাতায় সেগুলো লিখে ভালো নম্বর পাচ্ছে। এতে করে তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারও তেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে না। এ ছাড়া মেধা বা বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার সময় অনেক মানদণ্ডের বিচারে সেটা করা হয়ে থাকে। কাজেই পরীক্ষায় যারা খুব ভালো করতে পারছে না, তাদের যদি আমরা মেধাহীন হিসেবে চিহ্নিত করি, তাহলে খুব ভুল হবে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তোমার বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে জেনে খুব ভালো লাগল। আত্মিক বা মানসিক উন্নয়নের জন্য এই অভ্যাসটি তোমাকে ভবিষ্যতে অনেক সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমার বাবার এই নিষ্ঠুর আচরণগুলো সত্যিই খুব দুঃখজনক। তিনি কি কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন? তা-ই যদি হয় তাহলে তাঁর চিকিত্সার প্রয়োজন ছিল। আর যদি মানসিকভাবে তথাকথিত ‘সুস্থ মানুষ’ হয়েও তিনি এমন আচরণ করেন, তবে বুঝতে হবে তাঁর মধ্যে প্রকৃত অর্থে মানসিক সুস্থতার অভাব রয়েছে। বাবার প্রতি তোমার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, তুমি মাকে চোখের সামনে তাঁর দ্বারা অত্যাচারিত হতে দেখেছ। একটি সন্তানের জন্য এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা। বাবার প্রতি তোমার অনেক ক্ষোভ আছে বুঝতে পারছি, তবে এই নেতিবাচক আবেগ লালন করলে তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুমি এখন যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছ, নিজের আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সচেতনভাবে সচেষ্ট হও। নিজেকে সব সময় বলবে, ভবিষ্যতে তুমি তোমার স্ত্রীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবে এবং তোমার সন্তানদের সুস্থভাবে বড় করার জন্য পরিবারে একটি সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
সমস্যা: দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার নিচের ক্লাসের একটা মেয়েকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এ সম্পর্কে আমি আমার বন্ধুদের বলি। কিন্তু আমার এক বন্ধু কথাটা মেয়েটিকে বলে দেয়। ফলে মেয়েটা ও তার বান্ধবীরা বিষয়টা জেনে ফেলে। আমি আমার মামার বাসায় থাকি। পারিবারিক দিক থেকে আমি ভালো একটি ছেলে ছিলাম কিন্তু ওর এক বান্ধবী বিষয়টা আমার মামাকে বলে দেয় এবং তার সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করে, যা আমি কখনোই করিনি। এ অবস্থায় পারিবারিক দিক থেকে আমাকে নানা দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয়। কেউ আমাকে ভালো বলে মেনে নিতে পারে না। আমার দিকে সব সময় সন্দেহের একটা দৃষ্টি থাকে সবার।
মাহেক, ঢাকা।
পরামর্শ: এ বয়সের একটি ধর্ম হচ্ছে, বিপরীত লিঙ্গের কোনো মানুষকে হঠাত্ ভালো লেগে যাওয়া। তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়েছে। কাউকে ভালো লাগার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। আর তুমি তো এই অনুভূতিটি শুধু নিজের মনের মধ্যেই রেখেছ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, তোমার সঙ্গে একটি বড় ধরনের অন্যায় হয়েছে। ওরা যা-ই বলুক না কেন, তুমি এখনো একটি ভালো ছেলেই আছো, এ বিশ্বাসটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করো। যে মেয়েটি তোমার কথাটি বলে দিয়েছে, সেও বয়োসন্ধিতে রয়েছে বলে হয়তো আবেগের বশে এটা করেছে। তবে তার সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করে বলাটা তার অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। তবে তোমার পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি বোঝা উচিত ছিল। বুঝতে পারছি, সবার সন্দিহান দৃষ্টি তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। ওরা যা-ই বলুক না কেন, তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো না নিজেকে তবুও কিছুটা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয় কিনা। কারণ, তুমি তো ভালো করেই জানো, ওরা ঠিক ভাবছে না এবং অনেক ভুল করছে। তুমি যদি সততা আর নৈতিকতায় বিশ্বাসী হও, তাহলে ওরা নিশ্চয়ই একসময় তাদের ভুল বুঝতে পারবে।
সমস্যা: আমি বেশি বেশি চিন্তা করি। নানা আজব ও বাজে চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করে এবং চিন্তাটা আপনা-আপনি চলে আসে। অনেক চেষ্টা করেও মাথার মধ্যে থেকে বের করা যায় না। আর আমার মনের মধ্যে সব সময় একটা ভয় কাজ করে, যা সব সময় আমার ক্ষতি করে। ভয়টা হচ্ছে মৃত্যুভয়। কোনো জায়গা কিংবা কোথাও যেতে বললে আমার ভয়টা চলে আসে। যেন মনে হয়, কাজটা করলে আমি মারা যাব কিংবা মারা যেতে পারি। আমাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শুধু আমি। কিন্তু আমি ঠিকমতো চাকরি করতে পারি না। ঘুমোতে পারি না। খেতে পারি না।
মামুন, চট্টগ্রাম।
পরামর্শ: একই রকম বিষয়ে কিছু উত্তর আমি আগেও দিয়েছি। তুমি অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছ। জানি না কোনো চিকিত্সা এর মধ্যে নিয়েছ কি না। ঠিকমতো চিকিত্সা না হলে এ রোগটি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেড়ে যায় এবং রোগী ছাড়াও পরিবারের অন্যরা এতে খুব অসুবিধায় পড়ে। বর্তমানে তোমার মধ্যে নানা ধরনের ফোবিয়া বা ভয় দেখা দিয়েছে। আবার হয়তো কিছুদিন পরে অন্য ধরনের চিন্তা তোমাকে তাড়িত করতে পারে। একেবারে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো চিন্তাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রচণ্ডভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। নিজেকে কখনো এর জন্য দোষারোপ করবে না। কারণ, এ অবস্থাটি তুমি ইচ্ছে করে তৈরি করনি। যারা ডায়াবেটিস বা ব্লাডপ্রেসারের রোগী, তারা যেমন নিয়মিত চিকিত্সা নিয়ে ভালো থাকেন, তোমাকেও তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে চিকিত্সা নিতে হবে। পরিবারে যেহেতু তুমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম, তোমার কিন্তু বিলম্ব করা চলবে না। তুমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল অথবা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে গিয়ে চিকিত্সা নিতে পারো। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে যে গ্রুপ থেরাপি হয়, সেখানে অংশ নিলে দেখবে তুমি একা নও, অনেকেই তোমার মতো এই রোগের শিকার হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৭, ২০০৯
Leave a Reply