কোথায় যাচ্ছ?’
‘বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।’
‘এই সন্ধেবেলায়? এখন পড়াশোনার সময়। বাইরে যাওয়া চলবে না। ঘরেই থাকো।’
‘না বাবা, আমাকে যেতেই হবে। ওদের কথা দিয়েছি।’
‘ওদের কথা দিয়েছি, মানে? ওদের কি পড়াশোনা নেই? আমি তোমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করছি, তা তোমার গায়ে লাগছে না?’
বাবা খুব কড়াভাবে বললেন কথাটা।
এরপর ছেলেটির মুখ রাগে, ক্রোধে লাল। বাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুলদানিটা মাটিতে পড়ে খানখান। এরপর ছেলে ছোটাল কথার তুবড়ি। বাবা যে ওর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করছেন, তা নানাভাবে উদাহরণসহ বলতে শুরু করল ছেলে। এ ছেলেকে বাবা চেনেন না। এ ছেলেকে বাবা কোনো দিন দেখেননি। কারণ বয়ঃসন্ধিকালে ছেলের শরীর-মনে যে পরিবর্তনটি এসেছে, তা থেকে গেছে বাবার অগোচরে। ফলে প্রথম বিতর্কেই এক অচেনা ছেলের সঙ্গে পরিচিত হন বাবা।
এ রকম ঘটনা হামেশাই ঘটছে। দুই প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব তৈরি—চিরকালীন সমস্যা। মানুষ যখন থেকে সামাজিক জীবন যাপন করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই বাবা-ছেলের একে অন্যকে বুঝতে না-পারার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বয়ঃসন্ধি বা তারুণ্যের সময়টা বুঝে নিতে পারলে এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। এ জন্য উত্তরপ্রজন্মের চেয়ে পূর্বপ্রজন্মকেই সহনশীল হতে হবে বেশি।
অভিনয়শিল্পী আলী যাকের আর তাঁর ছেলে ইরেশ যাকের কীভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন, তা জেনে নেওয়া যাক।
‘যেকোনো মানুষ, যখন বুঝতে শুরু করে, তখন নানা রকম প্রশ্নের উদয় হয় তার মনে। সেই প্রশ্নজাত বিরোধ দেখা দিতে পারে বাবা-ছেলের মধ্যে। আমি মনে করি, বাবার বিরাট ভূমিকা রয়েছে এখানে। ছেলের চেয়ে বড় ভূমিকা বাবার। বাবা হিসেবে যদি কেবল আমরা একটু চিন্তা করি, আমাদেরও ওই বয়স ছিল, যখন আমরা ওই বয়স পার করেছি, তখন আমরাও বাবার প্রতি উদার ছিলাম না, একটু বিরোধিতা করার মনোবৃত্তি দেখা দিত—এ কথা মনে রাখলেই আমরা অনেক বেশি সংবেদনশীলতা নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে ঠিক আচরণটা করতে পারি।’ বললেন আলী যাকের। সংবেদনশীলতার ব্যাখ্যা করলেন তিনি এভাবে, ‘বুঝে নিতে হবে, আমার সন্তানের কী বিষয়ে কী কী চাহিদা হতে পারে। সেটা বুঝে যখন সন্তানের সঙ্গে কথা বলব, সন্তান যদি আমার কিছু কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেও থাকে, তার এ ভুল বোঝাটা খুব সহজেই দূর হতে পারে। সে আরও কাছে এগিয়ে আসবে। আমার কাছে তার যে প্রশ্নগুলো আছে, সেগুলো সে তুলে ধরতে পারে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাবা-সন্তানের যে বিরোধ, সে বিরোধটির সমাধান কখনোই কথা বন্ধ করে দিয়ে হতে পারে না। আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ, স্নেহ-ভালোবাসার যে আলোচনা, সেটি চালিয়ে যেতে হবে। ওকে বুঝতে দিতে হবে, ওর প্রশ্নগুলো গুরুত্বসহ দেখছি। কেবল এরই মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়ার সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে এ বিরোধটি বড় আকার ধারণ করবে না।’
‘কী ইরেশ, ওই বয়সে বাবাকে জ্বালিয়েছেন কেমন?’
প্রশ্ন শুনে হাসলেন ইরেশ। বললেন, ‘আসল দ্বন্দ্বটা শুরু হয় কুড়ির দিকে। এ প্রজন্মকে তো বাবারা ঠিকভাবে চেনেন না। তাই ছেলেদেরই বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, নতুন পরিস্থিতি মেনে নিতে কষ্ট হয় বাবার। বাবার যে অসুবিধা হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে ছেলেদের। এ দ্বন্দ্ব প্রতিটি প্রজন্মেই থাকবে। কিন্তু বাবা-ছেলের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান যদি থাকে, তাহলে একটা বয়সের পর বোঝাপড়াটা ফিরে আসে।’
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরেকটি প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, বাবা যদি ছেলেদের সামনে মায়ের প্রতি অবিচার করেন, তাহলে ছেলেরা তাদের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ ছাড়া বাইরে ওদের একটা জীবন গড়ে ওঠে, যার ফলে ঘরের সম্পর্কগুলো স্খলিত হয়ে যেতে পারে।
‘একটা ছেলে প্রথমে বাবাকে রোল মডেল মনে করে, পরে তাঁর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাবার বিরোধিতা করে থাকে।
ছেলে যদি উচ্ছন্নে যায়, নেশা করে, তাহলে সব বাবাই বাধা দেবেন। এটা বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। পরিবারের সম্পর্কগুলো যদি সুন্দর হয়, তাহলে ছেলে বাবার বিরোধিতা করে না।’
‘কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের সময় যেমন চাইছেন, তেমনভাবেই কি গড়ে তোলা যায় জীবন?’
‘না না, এটা তো মানতেই হবে, এটা একটা ভয়ানক বয়স। শারীরিক পরিবর্তন আসছে, গলা ভেঙে যাচ্ছে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে এ প্রজন্মের একটা বড় পার্থক্য আছে। আমাদের ওই বয়সে বাবারা আমাদের ঝাড়ি দিতেন, এখন ছেলেরা আমাদের ঝাড়ি দেয়। আমি মনে করি, সন্তানদের শিশু হিসেবে দেখা ঠিক নয়। ওদের সব ভালো কাজে উত্সাহ দিতে হবে। কিন্তু গাল টিপে আদর করে ওদের চারিত্রিক মনোবল নষ্ট করা ঠিক নয়। বড় মানুষের মতো ওদের সঙ্গে সম্মান করে কথা বলা উচিত। তার ইচ্ছাকে সম্মান করা উচিত। আমার কথাই বলি, ছেলেকে বলে দিয়েছিলাম, ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় কী হয়েছ, তা আমি জানতে চাই না, কিন্তু তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছ কি না, সেটাই দেখতে চাই। আরেকটা কথা, আমরা হরহামেশা অন্য ছেলের সঙ্গে নিজের ছেলের তুলনা করি, অর্থাত্ নিজের ছেলেকে ছোট করে দেখি। অমুকে এটা পারে, তুমি পার না—এ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। খারাপ করলে বরং উত্সাহ দিতে হবে। বলতে হবে, তুমি এর চেয়ে ভালো করতে পার না? ছেলে যদি বলে, পারি বাবা, তাহলেই হলো। তাহলেই ও আরও ভালো করার চেষ্টা করবে। ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে।’
দেখা যাক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বিষয়টি নিয়ে কী বলেন। ‘বয়ঃসন্ধিকালে ১৩-১৪ বছর বয়সের ছেলেদের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় মস্তিষ্কে হাইপো থ্যালামাস সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন রকম হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। বলা যায়, এ সময় হরমোনের জোয়ার আসে শরীরে। একটি ঘুমন্ত বাঘ যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফলে ছেলেটির মেজাজ আর আচরণে আসে পরিবর্তন। সে একটু আগ্রাসী হয়ে ওঠে। স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ সময় বাধা দিলেই লড়াই বেধে যায়। কেউ কেউ পুরো সময়টায় আগ্রাসী হয়, কারও কারও মধ্যে কখনো কখনো আগ্রাসী ভাবটা দেখা যায়। অতীত অভিজ্ঞতা নেই বলে বিষয়ের ভুল বিশ্লেষণ করতে পারে তারা। বন্ধুদের সঙ্গেও সব অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারে না। এসব থেকে হতাশা আসে, হতাশার কারণেই আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
‘এ সময় বাবা-মাকেই হতে হবে সবচেয়ে বেশি সহনশীল। এ বয়সী ছেলেরা তাদের অনুভূতির কথা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না। এককভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়েই ওরা হয়ে ওঠে মেজাজি, আগ্রাসী। একটু বড় হলে অবশ্য এ প্রবণতা কমে যেতে শুরু করে। এ সময় যদি বাবা ছেলেকে আদেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত পথে চালানোর চেষ্টা করেন, তাহলে ছেলে অবাধ্য হয়ে যেতে পারে। এটা কোরো না, ওখানে যেয়ো না—এ ধরনের বাক্য ছেলেকে বিদ্রোহী হতে শেখায়। তখন বাবাকে সে মনে করে প্রতিপক্ষ। এটা নেতিবাচক।
‘বাবা বেশির ভাগ সময় বাইরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছেলে যে বড় হচ্ছে, সেদিকে তাঁর নজর থাকে না। কেন ছেলের আচরণে পরিবর্তন আসছে, তা বিবেচনা না করেই ছেলের উগ্র আচরণের কারণে বিরক্ত হন তিনি। এ সময় ছেলের সঙ্গে অন্যায় আচরণও করে ফেলতে পারেন; কিন্তু সেটাই হবে ভুল। যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন, প্রতিদিনই ছেলেকে কিছুটা সময় দিতে হবে। বাবা যদি নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে ছেলেও নিজের মেজাজ ঠিক রাখবে। কোনো কোনো বাবা ছেলের আচরণে বিরক্ত হয়ে তাকে ঘর থেকে বের করে দেন, কঠোর হন—এগুলো খুবই খারাপ। বাবাকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। রাগ, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাবা সন্তানের বন্ধু না হলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।’
‘ছেলেটা কেন এ রকম আচরণ করে?’
‘এখন নানা ধরনের উত্তেজক চলচ্চিত্র, নাচ দেখছে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেরা। এতে ওদের হরমোন নিঃসরণ বিপজ্জনক হারে বাড়তে থাকে। তখন শারীরিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে ওরা। এ ধরনের পথে গেলে বিপদ আসবেই।’
বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব অনেক দিনের। সময়ও এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মকে আলাদা করে দেয়। দুই প্রজন্মেরই উচিত যথেষ্ট সংবেদনশীলতা দিয়ে বিষয়টির মোকাবিলা করা।
একটু সহনশীলতা, একটু সংবেদন বাবা-ছেলের সম্পর্ককে করে তুলতে পারে মধুর। সে রকম জীবনই তো চায় সবাই।
জাহীদ রেজা নূর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৩, ২০০৯
Leave a Reply