বুকে ব্যথা হৃদরোগের একটি বিপজ্জনক সংকেত বা উপসর্গ। সাধারণত বুকের বাম দিকে ব্যথা শুরু হয় বা বাঁ হাত, ডান হাত, উভয় হাত, দাঁত, ঘাড় বা উপর পেটে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় হৃদরোগের ব্যথাকে গ্যাষ্ট্রিকের ব্যথা ভেবে অনেকেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না বা বিলম্ব করেন, যা অনেক সময় মৃত্যুঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় রোগীরা স্হানীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে সঠিক রোগ শনাক্ত হয় না। অনেক সময় দেখা গেছে, হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেছে তিনদিন আগে কিন্তু রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্পর্শে আরো আগে এলেই এ রোগের ঝুঁকি কমাতে পারত। মনে রাখবেন-বুকে ব্যথা হলে, শরীরে ঘাম হলে, বমি বমি লাগলে বা বমি হলে কালক্ষেপণ করবেন না। হাসপাতালের ইমার্জেসিতে অথবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। বিলম্বে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। কারণ হার্টঅ্যাটাকে শতকরা ২৫ জন এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। যারা রয়ে গেল তাদেরও শতকরা ১৫ জন হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায়। হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত রোগী সময়মত হাসপাতালে পৌঁছলে ওষুধের চিকিৎসার পাশাপাশি আজকাল প্রাইমারি অ্যানজিওপ্লাষ্টি করা হয় যা আধুনিক বিশ্বে স্বীকৃত চিকিৎসা। বাংলাদেশেও অনেক চিকিৎসক প্রাইমারি অ্যানজিওপ্লাষ্টির মতো আধুনিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
বয়স চল্লিশের উপরে গেলে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত এবং জানা উচিত হৃদরোগের কোনো ঝুঁকিতে আপনি আছেন কি না। যেমন-উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে ভুগছেন কি না? রক্তের চর্বির পরিমাণ বা লিপিজ প্রোফাইল কেমন? এছাড়া পরিবারে হৃদরোগজনিত সমস্যার ইতিহাস আছে কি না? তাই আপনার চিকিৎসকের কাছে জেনে নিন আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি আছে কি না বা হৃদরোগে ভুগছেন কি না? এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় বা চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করুন। মনে রাখবেন, হৃদরোগীদের আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনা থেকেই যায়। মাত্র কয়েক মিনিটে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ঘটলেও এই মারাত্মক ব্যাধির উপসর্গ জেনেও প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া যেসব রোগী ইতোমধ্যে একবার হার্টঅ্যাটাক বা আনষ্ট্যাবল অ্যানজাইনার শিকার হয়েছেন তাদেরও হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি আছে, যা এখনো সারাবিশ্বে এক বড় আতঙ্ক। যারা ইতোমধ্যে একবার হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের আবারো হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়ে যায়। আরেকটি ব্যাপার গুরুত্বপুর্ণ তা হলো এসব রোগী দ্বিতীয়বার বা পুনরায় হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হবার ভয়ে থাকায় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এসব রোগীর মানসিকভাবেও সাহায্য করা উচিত। আর তাই চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে প্রয়োজন বন্ধুত্বপুর্ণ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। রোগী যাতে তার চিকিৎসকের সঙ্গে খুঁটিনাটি সব সমস্যার কথা ভাগাভাগি করতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বা করোনারি আর্টারিতে চর্বি ও অন্যান্য পদার্থের সংমিশ্রণে এথেরোসক্লোরোসিস (অয়ভপড়সঢ়ধলপড়সঢ়মঢ়) হয়ে রক্তের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে হৃদপিন্ডের ওই মাংসপেশিতে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এ অবস্হাকেই বলা হয় করোনারি আর্টারি ডিজিজ। কখনো কখনো করোনারি আর্টারি চর্বি বা কোলেষ্টেরল জমে আংশিক বা সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অ্যালজাইনা থেকে হার্টঅ্যাটাক হতে পারে।
হৃদরোগের উপসর্গঃ বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, শরীর ফুলে যাওয়া, শরীর নীল হয়ে যাওয়া ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
হৃদরোগের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতে নিম্নোক্ত সুপারিশ মেনে চলা উচিত-
–রক্তের চাপ বা ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণ রাখা
—ডায়াবেটিস বা ব্লাড গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা
–এলডিএল বা খারাপ কোলেষ্টেরল ১০০ মিগ্রা নিচে রাখা
–শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা
–ধুমপান ত্যাগ করা এবং
–কায়িক শ্রম বা প্রত্যহ হাঁটাহাঁটি করা।
বুকে ব্যথা হলে চিকিৎসকের উচিত রোগীর একটি ইসিজি করা। এছাড়া রক্তের ঈক-গই, ঞৎড়ঢ়ড়হরহ ও, ইষড়ড়ফ মষঁপড়ংব ইত্যাদি কিছু পরীক্ষা করা। কখনো কখনো ইকোকার্ডিওগ্রাফিও করা হয়ে থাকে।
রোগীর ইমার্জেসি চিকিৎসা প্রয়োজন হলে অ্যাসপিরিন ৩০০ দিতে হবে। এছাড়া নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে জিহ্বার নিচে দেয়া লাগতে পারে। অন্যান্য আরো ওষুধ ক্ষেত্র বিশেষে বা রোগীর অবস্হাভেদে ব্যবহৃত হয়। যেমন-ক্লোপিডোগেরল, বিটা ব্লকার, এসিই ইনহিবিটর, ষ্ট্যাটিন হেপারিন। কখনো কখনো ষ্ট্রেপটোকাইনেজ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া আজকাল জিপি ২বি ৩এ ইনহিবিটর ব্যবহৃত হয়।
মনে রাখবেন, আপনার বুকে ব্যথা চিকিৎসক ডায়াগনোসিস করতে পারেন টহংঃধনষব অহমরহধ, ঘঝঞঊগও বা ঝঞঊগ হিসেবে। করোনারি আর্টারি ব্লকেজের ওপর নির্ভর করেই রোগের তারতম্য হয়ে থাকে। কখনো কখনো ওষুধের চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো অ্যানজিওগ্রামের মাধ্যমে ব্লকেজের শতকরা হার জেনে করোনারি অ্যানজিওপ্লাষ্টি করা হয়। এছাড়া কখনো কখনো রোগী বুকে ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পৌঁছলে প্রাইমারি অ্যানজিওপ্লাষ্টি করা হয়। ব্লকেজের অবস্হা ভেদে কখনো কখনো বাইপাস সার্জারিও করা হয়।
বি.দ্র. এই লেখাটি ভারতের ম্যাক্স হার্ট এন্ড ভাসকুলার ইনষ্টিটিউটে ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিতে ফেলোশিপ করার সময় অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে।
—————
ডা. এস এম মোস্তফা জামান
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, চেম্বারঃ ল্যাবএইড লিমিটেড, বাড়ি-১, রোড-৪, ধানমন্ডি, ঢাকা।
আমার দেশ, ৩ জুন ২০০৮
Leave a Reply