সমস্যা: আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের বন্ধুরা থেকে শুরু করে অপরিচিতরাও অকারণে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বন্ধুদের অনেকেই বলে, আমি নাকি অনেক সুন্দর। এ ছাড়া সবাই আমার সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করি। বয়সের তুলনায় আমি কিছুটা খাটো এবং আমার বাচ্চাদের মতো স্বভাব রয়ে গেছে। ফল আমি সব সময় হীনম্মন্যতায় ভুগি। বছর তিনেক আগে আমার ছোট বোনের এক বান্ধবী তার বড় বোনসহ আমাদের বাসায় আসে। ওর বড় বোনকে আমি একবার মাত্র দেখেছি। কিছুদিন আগে সে আমার অঙ্ক স্যারের কাছে ভর্তি হয় এবং এরও কিছুদিন পর হঠাত্ তাকে আমি চিনে ফেলি। ফলে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পরদিন দেখি মেয়েটাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং চোখে চোখ পড়লেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। অনেকদিন থেকেই সে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি ওর দিকে তাকানোর সাহস পাই না।
আবদুল্লাহ আল ফাহিম
পরামর্শ: তোমার এবং মেয়েটির এখন যা বয়স, তাতে এ ধরনের আবেগ কাজ করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তোমার চেহারা সুন্দর বলে মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি বোধ করাটাও স্বাভাবিক। তবে যদি অন্তত পরিচিতদের বলতে পার যে তোমার এতে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে, তাহলে ভালো হয়। এতে করে তোমার সামাজিক দক্ষতার কিছুটা অনুশীল হবে। বয়সের তুলনায় তুমি খাটো, এটা নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা না করলেও তো চলে। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হওনি, কাজেই আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার সযোগ তো রয়েছে। আর এ ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও যদি তোমার উচ্চতা খুব বেশি না হয়, সেটা নিয়ে হীনম্মন্যতায় না ভুগে তুমি বরং নিজের অভ্যন্তরীণ বিকাশগুলো করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হও। যেমন সামাজিক দক্ষতার বিকাশ, অর্থাত্ মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশার ক্ষমতা, যেকোনো সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা—এই বিষয়গুলোর ওপর যেসব বই পাওয়া যায় সেগুলো পড়ো। আজকাল তো ইন্টারনেটে ঢুকেও জ্ঞানার্জনের অনেক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সুস্থ বিনোদনের জন্য ভালো গান, গল্প, এগুলো পড়ার চেষ্টা করবে, কেমন? যে মেয়েটি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকছে, তাকে সাহস করে সরাসরি জিজ্ঞেস করো, সে কী বলতে চায়। যদি সে বলে, তোমাকে তার ভালো লাগে, তাহলে উত্তরে তুমি কী বলবে তাও ঠিক করে রাখো। তবে আমি মনে করি, মেয়েদের শুধু মেয়ে হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে এবং সমবয়সী বন্ধু হিসেবে প্রথমে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। প্রথমেই একটি প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে বরং আগে বন্ধু হিসেবে যদি মেয়েদের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে মিশতে পার, তাহলে দেখবে সংকোচ কেটে যাবে। জীবনসঙ্গী হিসেবে কাউকে বেছে নেওয়ার জন্য আরও অপেক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনমানসিকতায় অনেক পরিবর্তন আসে। তাই বয়সে কারও সঙ্গে নিজেকে ছড়িয়ে ফেললে পরবর্তী সময়ে জীবনে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে।
সমস্যা: আমার বয়স ২১ বছর। আমার সমস্যা হলো, আমি ঠিকমতো কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। কথা বলতে বলতে শরীর ঘেমে যায়। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন খুব লজ্জা লাগে। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারি না। সব সময় একা থাকতে মন চায়। কোনো কিছু ভালো লাগে না। সব সময় মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খায়। কোনো কাজে মন বসে না। কোনো কিছু মনে থাকে না। অনেক সময় সামান্য কারণেই রেগে যাই এবং সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। কিন্তু আমি এই পৃথিবীতে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই এবং সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তোমার মধ্যে ‘সোশ্যাল ফোবিয়া’ এবং বিশেষ এক ধরনের ‘পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের’ বেশ কিছু উপসর্গ রয়েছে। অন্যান্য ফোবিয়া মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও সোশ্যাল ফোবিয়া ছেলেদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় শতকরা দুই ভাগ এ সমস্যায় ভুগছে। এ ধরনের ফোবিয়ার সঙ্গে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, ভয় এবং কিছু পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার উপস্থিত থাকে। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে এই অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। তবে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এই বলে যে, তুমি নিজের মানসিক দিকটির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন বলেই বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে চিহ্নিত করে আমাকে লিখেছ। আমি চাইব তোমার পরিবারের যে মানুষটির সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তাকে তুমি এই মানসিক অসুবিধাগুলোর কথা খুলে বলো। তুমি দেরি না করে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে সাইকোথেরাপির সাহায্য নাও। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে যেতে পার। উপযুক্ত চিকিত্সা নিলে তুমি অনেক ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হবে।
সমস্যা: আমার পড়াশোনা থেকে মনোযোগ উঠে গেছে। আমার পরীক্ষার আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। আমাকে বাসা থেকে পড়াশোনার জন্য বাড়াবাড়ি রকমের চাপ দেওয়া হচ্ছে ইদানীং। বাবা-মা বা ভাই, প্রত্যেকের কথাই চরম বিরক্ত লাগে। ইদানীং তাঁদের শত্রু মনে হয়। আমি বুঝতে পারছি যে আমি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। এর পরও নিজেকে ফেরানোর কোনো রাস্তা পাচ্ছি না।
আনিতা, ঢাকা।
পরমার্শ: আমি বুঝতে পারছি তোমার পরীক্ষার পড়া পড়তে একদম ভালো লাগছে না। আর অন্যরা পড়ার জন্য জোর করলে আরও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছ। ছেলেবেলায় কি তোমাকে খুব জোর করা হয়েছে লেখাপড়ার জন্য? আমরা বড়রা অনেক সময় ছোটদের মনটা বোঝার খুব চেষ্টা করি না। উত্সাহ দিয়ে, প্রশংসা করে যদি ছোটদের লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ আনার চেষ্টা করা হয়, তাহলে খুব উপকার হয়। তুমি যদি জেদ করে পড়ালেখা কম কর, তাহলে একদিন দেখবে নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগছে। এ ছাড়া বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গেলে তুমি কি ভালো থাকতে পারবে? সব চিন্তা মাথা থেকে একদম সরিয়ে দিয়ে নিজের ভেতরের সত্তাটিকে দেখো না একটু ভালোবাসা যায় কি না! নিজেকে বুঝিয়ে যদি কিছুটা মনোযোগ আনতে পার, দেখবে পরে নিজের প্রতি আস্থা অনেক বেড়ে যাবে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১০, ২০০৯
Leave a Reply