‘ঘরের এক কোণে বাটা হচ্ছে মেহেদি পাতা। এরই মধ্যে জড়ো করা হয়েছে দেশলাইয়ের কাঠি আর চিকন শলা। মেয়েরা হাসছে, গল্প করছে। বাটার কাজ শেষ হলেই কে আগে হাত পেতে দেবে, তা নিয়ে শুরু হচ্ছে প্রতিযোগিতা। চারদিকে যেন উত্সব লেগেছে! কিন্তু কে ভালো করে লাগাতে পারে মেহেদি? তাকেই তো দরকার এখন! কেউ একজন বলে ওঠে, পাশের বাড়ির ভাবি বা চাচি বা বড় বোনটি নিখুঁতভাবে রাঙিয়ে দেয় হাত। ব্যস! কথাটুকু শুনতেই যা সময় নষ্ট হয়। একদল মেয়ে ছুটে গেল সেই মানুষটিকে এখানে হাজির করার জন্য। হাসতে হাসতে জোর করে ধরে আনা হলো তাঁকে। এবার রাঙিয়ে দেওয়ার পালা। একজনের পর একজন পেতে দিচ্ছে হাত আর সে হাতে তৈরি হচ্ছে শৈল্পিক কারুকাজ। পাশাপাশি চলছে খুনসুটি, হাসাহাসি, গল্প। আমাদের সময়ে এ রকমই ছিল চাঁদরাতে মেহেদি উত্সব।’ জানালেন হারমনি স্পার কর্ণধার রাহিমা সুলতানা রীতা।
সময় পাল্টেছে। ঘরের এই আনন্দ উত্সবটি সেভাবে আর টিকে নেই। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে বিউটি পার্লারগুলো। তবে যেখানেই মেহেদি লাগানো হোক না কেন, ঈদের আগে মেহেদি লাগানো চাই-ই চাই।
শখের নকশা
মেহেদি কে না ভালোবাসে! ভালোবেসে মেহেদি পরানোর আগে কিছু কথা মনে রাখতে হবে—
মেহেদিটা হতে হবে ভালো।
একজন সাহায্যকারী থাকতে হবে।
মেহেদি লাগানোর জন্য একটি জায়গা দরকার হবে।
পিরানের কর্ণধার ও আলংকারিক হোসনা বানু ছোটনা। পড়েছেন চারুকলায়। ঈদের সময় মেহেদি লাগানোকে কেমন লাগে তাঁর কাছে, কেমন লাগে এই উত্সব, কেমন লাগে হাতে করা মেহেদির নকশা—এই ছিল প্রশ্ন। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, ‘চারুকলায় যখন পড়তাম, কিংবা পাস করে বের হওয়ার সময়টিতে ঈদের আগে ৩০-৩৫ জনের হাতে নকশা করে দিতাম।’ সে সময় নকশা বলতে তেমন কিছু ছিল না। হাতের মাঝখানে আঁকা হতো বৃত্ত। আর এর চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট ফোঁটা দেওয়া হতো। কেউ বা পুরো হাতে লেপ্টে দিত মেহেদি। যারা নিখুঁতভাবে মেহেদি লাগানোয় হাত পাকিয়েছিল, তারা আঁকত ফুল কিংবা লতাপাতা।
সময় পাল্টেছে। বাজারে এখন টিউব মেহেদির ছড়াছড়ি। এখন সরু, মোটা, হালকা, গাঢ় সব ধরনের নকশাই তৈরি করা যায়। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে আরবীয়, ভারতীয়, পাকিস্তানি নকশা। ‘এ যেন একটির সঙ্গে আরেকটি প্যাটার্নের মিলে যাওয়া, একটু এদিক-ওদিক হলেই যেন খাপছাড়া হয়ে যাবে। তবে সেটার সৌন্দর্যও আলাদা।’—বললেন হোসনা বানু।
বয়সের সঙ্গে মানানসই নকশা
সাধারণ মেহেদির পাশে কাল মেহেদির রেখা টেনে দেওয়াটাই ঈদের নতুন ফ্যাশন। কিশোরীদের জন্য এই নকশাটাই এবার মানানসই বলে জানালেন রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান। তিনি জানান, কিশোরীরা হাত ভর্তি করে দিতে পারে। পাশাপাশি শুধু চিকন রেখা টানাটাও মানিয়ে যাবে। এটি বেশি মানাবে হাতের উল্টো দিকে।
মাঝ বয়সীদের হাতের উল্টো দিকে নকশা মানাবে না। বরং হাতভর্তি অলংকৃত নকশাই বেশি প্রযোজ্য হবে। যাঁরা বয়স্ক, তাঁদের জন্যও আছে নকশা। অনেকেই পছন্দ করেন না হাতভর্তি মেহেদি। হাল ফ্যাশনের নকশাও যেন আর টানে না। এ সময় নখ ঢেকে দিয়ে বা আঙুলের ওপরের এক দাগ পর্যন্তই পছন্দ করেন। তিনি জানান, চিকন নকশা না করে হাতের মাঝে পুরু করে লাগাতে পারেন। ১৫-২০ দিন থাকবে।
পোশাকের সঙ্গে মানানসই নকশা
কোন পোশাকের সঙ্গে কোন নকশাটি ভালো যাবে, সে সম্পর্কেও বললেন কানিজ আলমাস খান। পাশ্চাত্য পোশাকের সঙ্গে কাল মেহেদি দিয়ে অঙ্কিত অল্প নকশাই ভালো লাগবে। যাঁরা শাড়ি অথবা সালোয়ার-কামিজ পরবেন, তাঁদের জন্য নকশা হবে কিছুটা ভিন্ন। হাতভর্তি কিংবা একটু বেশি নকশা মানিয়ে যাবে পুরোদমে। কারুকার্যে প্রাধান্য পেতে পারে লতাপাতা, ফুল বা কলকা।
বাসায় বানাতে পারেন টিউব মেহেদি
বাজারে পাওয়া টিউব মেহেদি পছন্দ করেন না অনেকেই, বাসায় বাটা মেহেদিপাতার গন্ধ আর রংটাই যেন মন খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সেটা দিয়ে তো আর বাহারি নকশা আনা যায় না। রাহিমা সুলতানাা জানালেন সহজ উপায়ে ঘরে বসে মেহেদি বানানোর পদ্ধতি। মেহেদিপাতা যত্ন করে বাটতে হবে। মিহি হওয়া চাই। এবার চায়ের ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলুন। চায়ের ছাঁকনির ছিদ্রগুলোও হতে হবে মিহি ছোট ও মিহি। খয়ের মেশাতে পারেন, যদি গাঢ় রং চান।
বাটার পেপারকে সুন্দর করে কোণ বানান (এই কাগজগুলো ব্যবহার করা হয় কেকের ওপর ক্রিমের নকশা করার কাজে)। সামনের ছিদ্রটি যাতে সূক্ষ্ম চিকন হয়। আঠালো টেপ দিয়ে ভালোমতো চারপাশ আটকে ফেলুন। পেছনের দিকটা খোলা রাখতে হবে। মেহেদি ঢালুন কোণটিতে। পেছনের অংশটুকু এবার ভালোমতো আটকে ফেলুন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল আপনার মেহেদি কোণ। যাতে নেই কোনো রাসায়নিক পদার্থ।
তবে মাঝে মধ্যে বেশি পাতলা হয়ে যায় বাটা মেহেদি। এ ক্ষেত্রে সঙ্গে মিশিয়ে দিন গুঁড়ো মেহেদি পাউডার।
বিভিন্ন ধরনের মেহেদি
সময়ের সঙ্গে শুধু মেহেদি দেওয়ার উপকরণটি বদলে যায়নি, বদলে গেছে এর রংও বৈকি। গ্লিটার মেহেদির পাশাপাশি রাজত্ব করছে কাল মেহেদিও।
কাল মেহেদির উপকরণ পুরোপুরি রাসায়নিক। এতে কোনো মেহেদি থাকে না। হাতে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর উঠিয়ে ফেললে লাল রং পাওয়া যাবে। হাতে শুকিয়ে গেলে পুরো কাল রংটাই ধারণ করে থাকবে। পাশ্চাত্য তাড়নায় এটি বেশ জনপ্রিয় এখন আমাদের দেশে। বিয়ে কিংবা উত্সবে লাগানো হচ্ছে ধুমছে।
মেহেদি প্রস্তুতি
অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে সাবান দিয়ে। শুকনো করে মুছে ফেলুন। মেহেদি লাগানোর আগে হাতে ক্রিম বা তেল লাগাবেন না। পছন্দমতো নকশায় এবার এঁকে ফেলুন দুই হাত।
হাতে লাগানো মেহেদি পুরোপুরি শুকোতে দিন। শুকিয়ে গেলে লেবুর রস লাগান। ১৫-২০ মিনিট রাখতে হবে আরও। ধুয়ে হাতে তেল লাগান সামান্য। রং গাঢ় হবে এতে।
ঈদের যত কম ব্যবধানে মেহেদি লাগানো যাবে, ততই ভালো। সবচেয়ে ভালো হবে যদি চাঁদরাতে লাগান। অন্তত ঈদের তিন দিন মেহেদিটুকু আলোকিত করে রাখবে আপনার হাত দুটি।
লেখা ও মেহেদি পরানো: রয়া মুনতাসীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০০৯
Leave a Reply