পুরান ঢাকার বংশালের আল রাজ্জাক হোটেলের সামনে যেতেই দীর্ঘ যানজট। দুই পাশের গাড়িগুলোই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার?
আল রাজ্জাকের ইফতারি নিতে মানুষের ভিড়। অনেকেই নিজস্ব যানবাহন রাস্তার ওপর রেখেই ইফতারের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য কেনাকাটা করছেন।
গুলিস্তান হয়ে নতুন ঢাকা থেকে পুরান ঢাকায় প্রবেশ করে ইফতারি কিনতে সম্ভবত প্রথমে আল রাজ্জাকেরটাই চোখে পড়বে। এখানে রয়েছে প্রায় ১৫ পদের ইফতারি। বেগুনি, পেঁয়াজু, বুট, ঘুগনি, জালি কাবাব, ডিম চপ, জিলাপি, আরও কত কী।
বংশাল হয়ে চিত্রামহল প্রেক্ষাগৃহ হাতের বাঁয়ে রেখে নয়াবাজারের দিকে যেতেই পড়বে ইউসুফ মার্কেট। এখানে পাওয়া যাচ্ছে নানা রকম ফল। রাস্তার দুই ধারে এসব ফলমূল অন্যান্য বাজারের তুলনায় বেশ সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণত যাঁরা সারা দিন রোজা রেখে ফলমূল দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করেন, তাঁরা এ জায়গা থেকে ফলমূল কেনাকাটা করেন। ফলমূলের মধ্যে আছে পেঁপে, বাঙ্গি, মালটা, নাশপাতি, বেদানা, আঙ্গুর, তরমুজ, বাতাবীলেবুসহ নানা রকমের কলা।
মহানগর জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত এসব ফলের ভ্রাম্যমাণ দোকানের পসরা মেলে বসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তারপর গন্তব্য চকবাজার। মিটফোর্ড হাসপাতালের গলিতে ঢুকতেই নাকে এসে ঠেকে পারফিউমারের দোকানগুলো থেকে আসা সুগন্ধ। তবে কষ্ট একটাই, অসহনীয় যানজট। একই রাস্তা দিয়ে রিকশা, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, ঠেলাগাড়ি, আবার দিনমজুরদের ছোটাছুটি।
মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ইমামগঞ্জ পৌঁছাতে লেগে যাবে প্রায় ২০ সময়। অবশ্য হেঁটে গেলে সময়টা একটু কম লাগবে। কিন্তু এত মানুষ হেঁটে কোথায় যায়?
এক সুতা বিক্রেতা বললেন, ‘চকে যাইতাছে। আপনি ভি যাইতাছেন নি? যায়া পারেন। তয় মোটরসাইকেল রাখবার পাইবেন না।’
পিপিলিকার গতিতে যেতে যেতে অবশেষ চকবাজারের দেখা মিলল। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। কেউ ইফতারের নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য কিনে বাড়ি ফিরছেন, কেউ কিনছেন, আবার কেউ কিনতে আসছেন।
বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ। কেউ ছাড়ছে হাঁক, ‘এই বড় বাপের বড় পোলায় খায়, ২৫০ টাকায় লইয়া যায়।’
বোঝা গেল, এই সেই ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার ইফতারির বাজার। মানুষের ভিড় ঠেলেই সংগ্রহ করতে হবে ইফতারি। তবে কোনটা রেখে কোনটা কিনবেন, তা বাছাই করতে হলে বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখতে হবে আগে।
প্রথমেই পড়বে ফলমূলের দোকান। এখানেও রয়েছে দেশীয় নানা ফল। এরপর দেখা যায় ইফতারের নানা রকম খাবার। কী নেই এখানে? বড় বড় টেবিল রাস্তায় ফেলে তার ওপরই সাজানো হয়েছে সেসব পণ্য। টেবিলের নিচে ছোট ছোট চুলো। তার ওপর কড়াইয়ে টগবগে গরম তেল। সেখানেই তৈরি হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য।
একজন ক্রেতা দোকানিকে প্রশ্ন করলেন, ‘বড় বাপের বড় পোলায় খায়, এই খাবারে কী আছে, ভাই! আর এর নামই বা এমন কেন?’
দোকানি হেসে বলেন, ‘বুঝবার পান নাই কা-ছব্বাই এইডা খাইবার পায় না। বহুত দাম। এই লাইগ্যা কয়, খায় বড় বাপের বড় পোলায়। এইহানে যা দেখতাছেন, ছব মিইল্যাই হইছে বাপের বড় পোলা।’
খেয়াল করে দেখা গেল, এই খাবারে কাবাব করা মুরগির মাংস ছোট ছোট করে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছেঁড়া হয়। তারপর ঘুগনি, ছোলা, বেগুনি, আলুর চপ এসব একসঙ্গে সেখানে একটু মাংসের মাখা মাখা ঝোল মিশিয়ে মিক্সার তৈরি করা হয়। তারপর প্রস্তুত হয় বড় বাপের পোলা।
পাশের এক দোকানির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ‘খালি ১৮০, ১৫০, খালি ১৮০ আর ১৫০। লইয়া যান। এই ফুরায়া গেল। এই যে গরম গরম। কচি মুরগি। হাড্ডি ভি কুরমুরাইয়া খাইবার পাইবেন।’
দেশি ও ব্রয়লার-দুই ধরনের ছোট ছোট আকারের মুরগি মসলা দিয়ে মাখিয়ে ঝলসানো হয়েছে আগুনে। সেটা বিক্রি করা হচ্ছে। দেশি মুরগির কাবাব কালো-লালচে রঙের আর ব্রয়লার মুরগির রংটা হবে একটু হলদেটে।
এইবার চোখের সামনে পড়ল সুতি কাবাব। গরু ও খাসি-দুই ধরনের মাংস দিয়ে এই সুতি কাবাব তৈরি করা হয়। একেক দোকানে একেক রকম দাম। কাবাবের মাংস সুতা দিয়ে গাঁথা।
চকবাজারে সবার দৃষ্টি কেড়েছে আনন্দ কনফেকশনারি। পরোটা থেকে চিকেন কাটলেট-কী নেই এখানে। মানুষের ভিড়টাও এখানেই সবচেয়ে বেশি। ১৫-২০ মিনিট সময় লেগে যাবে এখান থেকে সব পণ্য দেখেশুনে কিনে নিতে। অন্যান্য দোকানের চেয়ে প্রতিটি পণ্যের দাম অবশ্য দুই-তিন টাকা করে বেশি। তবু এখানেই বেশি মানুষের আগমন। কারণ খাদ্যদ্রব্যের পরিবেশন স্বাস্থ্যসম্মত বলে অনেকেই মনে করেন।
এখানে আলুরই রয়েছে একাধিক রকমের চপ। ডিম চপ, কিমা চম, শুধু আলুর চপ। এগুলো পাঁচ থেকে শুরু করে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। আছে কাবাব পরাটা। আছে আরও অনেক পণ্য।
একটু সামনে যেতেই চোখ আটকাবে যে দৃশ্য সেটি শাহি জিলাপি। গরম তেলের মধ্যে কারিগর সুনিপুণ হাতেই তেলের মধ্যে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন বিশাল আকৃতির জিলাপি। মুহূর্তের মধ্যেই তা ভাজা হয়ে যাচ্ছে এবং চিনির সিরার মধ্যে তা ডুবিয়ে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই ক্রেতারা তা নিয়ে টেবিল প্রায় খালি করে ফেলছেন।
দাম কত?
দোকানি বললেন, ‘ছোটটা ৮০, মাঝারিটা ১০০, বড়টা ১৪০ টাকা প্রতি কেজি।’
শাহি জিলাপির দোকান ছেড়ে সামনে যেতেই চোখ পড়ছে খাসির রানের রোস্টের দিকে। ছোট ছোট খাসির রান রোস্ট করা হয়েছে। গোটা একেকটি রানের মূল্য ৩৪০ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। নানা রকম মসলা দিয়ে রানগুলো সুস্বাদু করে তোলা হয়েছে। এ জন্য দোকানের কাছে গেলে নাকে এসে ঠেকল অদ্ভুত সুন্দর একটি ঘ্রাণ। এর সুবাসেই অনেকে কিনছেন খাসির রান।
চকে ইফতারিপণ্যর মধ্যে আরও রয়েছে। রোস্ট পাওয়া যাবে কবুতর, কোয়েল পাখি-এমনকি রাজহাঁসেরও।
চকবাজারে আছে মাঠা এবং ছানাও।
জনপ্রতি ২০ টাকা দিলেই হাতে পাবেন খাঁটি ছানা। সামান্য একটু চিনি মিশিয়ে সেই ছানা খেতে যে কী স্বাদ তা বললেন ছানা-ক্রেতারা। আর ৪০ টাকা দিলেই পলিব্যাগে তৈরি করে রাখা মাঠা পাওয়া যাবে নিমিষেই।
খোঁজ পাওয়া গেল লস্যির। চকের ইফতারি বাজারের পরের গলিতে। সেখানে দেখা গেল আর এক দৃশ্য। ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। প্লাস্টিকের বোতলে ২০ টাকা থেকে শুরু করে যত খুশি তত টাকার মজার লস্যি সংগ্রহ করা যাবে অনায়াসে। দু-একজন বললেন, ‘ছবের মইধ্যে দুই লম্বরি ঢুইক্যা গেছে, মাগার লস্যি ভি অহনও এক লম্বর। আর ভি পাইবেন না।’
সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে অনেক আগেই।
মোটরবাইক নিয়ে রওনা হলাম। এবার উল্টো রাস্তায় পথ ধরলাম। কিন্তু অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে, চকের ইফতারের এখন ছড়িয়েছে প্রায় উর্দু রোড পর্যন্ত।
নতুন ঢাকা থেকে যাঁরা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতারি চকবাজার থেকে কিনতে চান, অবশ্যই তাঁকে তিনটা থেকে বিকেল চারটার মধ্যে যেতে হবে। যানজট এড়াতে চাইলে চানখাঁর পুল হয়ে বকশিবাজারের সামনে দিয়ে জেলখানার সামনে দিয়ে উর্দু রোডের ভেতর দিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।
কামরুজ্জামান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০১, ২০০৯
Leave a Reply