সমস্যাঃ আমার প্রধান সমস্যা হলো আমার চেহারা নিয়ে আমি সব সময় মানসিক সমস্যায় ভুগি। এ সমস্যা আমার অনেক ছোটবেলা থেকে ছিল। তবে এখন আরও প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। আমি এ জন্য হল থেকে বাইরে, এমনকি নিচেও নামি না প্রয়োজনে। মাঝেমধ্যে বাসায়-বারান্দায়, ছাদে এমনকি বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে তবুও পারি না। যেমন হঠাৎ ইচ্ছা হলো কোথাও বেড়াতে যাব কিন্তু যে মুহূর্তে তৈরি হতে যাই তখন আর কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করে না। আমার প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় আমি খুব বিশ্রী দেখতে, সবাই হয়তো আমাকে নিয়ে কিছু বলাবলি করছে। আমার অনেক বন্ধু আছে। তারা আমার সঙ্গে বেশ ভালো, বরং আমাকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় আমি পড়ালেখায় ভালো বলে ওরা আমাকে এত বেশি পছন্দ করছে। যদিও ভাবনাটা ঠিক নয়। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় সবকিছু ছেড়ে এমন এক স্থানে যাই যেখানে কেউ আমাকে দেখবে না। এ জন্য মাঝেমধ্যে একদম বই ধরি না। আমার বয়স ২২। আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।
অনামিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরামর্শঃ তোমার সমস্যাটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিল শুধু তুমি একা নও, বাংলাদেশের অনেক মেয়েই নিজেদের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে। যারা এই সমস্যায় রয়েছে, তারা নিজেরা কোনো দোষ না করেও কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের গোটা সমাজটাই শুধু মেয়েদের বাইরের রূপের ওপরেই সবটুকু গুরুত্ব দিয়ে রেখেছে। পরিবারের ভেতরে, বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রায় সব জায়গাতেই মেয়েদের বাইরের সৌন্দর্য নিয়ে খুব আলোচনা হয়। যে মেয়েটি দেখতে একটু কম সুন্দর তাকে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয় নিজের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। অনেক সময় নিজের মায়ের কাছ থেকেও। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসেছে বলে আমাকে এই কষ্টের কথাগুলো শুনতে হয়েছে। কিছু কিছু বিজ্ঞাপন নির্মাতাও অত্যন্ত অসংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে তাদের বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেন। বাইরের সৌন্দর্য নিয়ে এই বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে, যারা মনে করছে তারা ততটা আকর্ষণীয় নয় তাদের মধ্যে নিজেদের আড়ালে রাখার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। তুমিও তাই করছ বলে অনেক বিনোদনমূলক কার্যক্রম থেকেও নিজেকে বিরত রাখছ। বাইরের সমাজের নিষ্ঠুরতা কি কমবে তুমি নিজের প্রতি এ ধরনের অবিচার করলে? তোমার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক ভালো গুণা রয়েছে আর মনটা সুন্দর বলেই তো অনেকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর তারা তোমাকে ভালোবাসে ভেতরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় বলেই। তোমার ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট করার মতো সামাজিক দক্ষতার সঙ্গে আরও অনেক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই কথাটা এখন থেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে, কেমন? সেই সঙ্গে তোমার সার্বিক ব্যক্তিত্বে যেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পায় সে জন্য নিজের মনটিকে সমৃদ্ধ করো। নানা ধরনের ভালো বই ও পত্রপত্রিকা পড়তে পার। দেখতে পার ভালো সিনেমা। এ ছাড়া চেষ্টা করো সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চাগুলোতে অংশ নিতে। ভবিষ্যতে তুমি সমাজের বঞ্চিত মানুষের জন্য এবং বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানোর জন্য কিছু করবে তেমন প্রতিজ্ঞাও মাথায় রাখবে। দেখবে তখন তোমার প্রতি পদক্ষেপেই আত্মবিশ্বাস অনুভব করবে। নিজেকে বেশ ব্যস্ত রাখতে পারলে সারাক্ষণ এই নেতিবাচক চিন্তা তোমাকে আর ঘিরে রাখতে পারবে না। দেখ না চেষ্টা করে নিজে ভেতরটাকে আরও বেশি ভালোবেসে নিজেকে বেশি করে ভালোবাসতে আর শ্রদ্ধা করতে পার কি না?
সমস্যাঃ আমি একজনের সঙ্গে প্রেম করেছি। সে খুব সুন্দর এবংবিবাহিত। সে আমাকে একদিন না দেখলে কাঁদতে থাকে-সব ছেড়ে সে আমারই ধ্যান করে। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আমারই অপেক্ষায় থাকে রাস্তায়। আজ ১০ বছর প্রেম করেছি। কিন্তু ঘর বাঁধার জন্য সে আসতে চায় না এবং আমাকে বিয়ে করতে দিতে চায় না। সে এত সুন্দরী যে তার জন্য সারা জীবন বিয়ে না করেও থাকা যায়। কিন্তু ১০ বছর অপেক্ষায় থেকে অবশেষে হঠাৎ বিয়ে করি। এ কথা শুনে সে খুবই কাঁদল এবং বউ ছেড়ে দিতে বলল। বলল সে আমার কাছে আসবে। তার কথায় বউ ছাড়লাম। কিন্তু এখন আর সে পত্র দেয় না, দেখা করে না-এমনকি আসতেও চায় না।
এম তারেক
পাইকগাছা
পরামর্শঃ মনে হচ্ছে তোমাকে তোমার রূপসী মেয়েটি দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে কিছুটা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। অবশ্য এটাও ঠিক সেখানে তোমারও স্বার্থ ছিল বলেই তুমিও তাতে সায় দিয়েছ। মেয়েটি কিন্তু তার স্বামীকে, সন্তানদের এবং তোমাকেও ঠকিয়েছে। তুমিও তার কথামতো সবকিছু করতে গিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে স্ত্রীর প্রতি খুব বড় অন্যায় করেছ। তুমি শুধু রূপসী মেয়েটির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছ, কিন্তু তার নৈতিকতাবোধ এবং সঠিক সামাজিক মূল্যবোধের অভাব তোমাকে স্পর্শ করেনি। যদি সে তোমার প্রতি আন্তরিক এবং সৎ হতো তাহলে এত দীর্ঘ সময় ধরে একই সঙ্গে দুটো সম্পর্ক চালিয়ে যেত না। যদি এটা হয় যে শুধু খুব সুন্দরী বলে তুমি তাকে ভালোবেসেছ তাহলে খুব ভুল হয়েছে, সেটা মানতে হবে। দেখা যাচ্ছে ওর স্বামী এবং তোমার স্ত্রী দুজনেই বিনা কারণে শাস্তি পেল।
একবার নিজের সত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে প্রশ্ন করে দেখ, শুধু ওর পরামর্শে তুমি একটি সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধনকে অস্বীকার করে স্ত্রীকে ত্যাগ করেছ, নাকি তুমি মোটেও সিরিয়াস ছিলে না এই বিয়ের ব্যাপারে? অবচেতন মনের তাড়নায় তুমি কি রূপসীকে তোমার জীবনে আসতে রাজি করানোর জন্যই আর একটি মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করলে? যাকে বিয়ে করেছিলে তাকে কি শুধু তুমি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলে? তাই যদি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তুমি আর এ ধরনের অন্যায় করবে না এমন প্রতিজ্ঞা করবে নিজের কাছে, কেমন? আমার আরও মনে হচ্ছে রূপসীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কে মানসিক বন্ধনের চেয়ে শারীরিক আকর্ষণই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এই ব্যাপার ঘটলে সম্পর্ক কিন্তু খুব শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ায় না। তুমি তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে কি না সেই প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছ থেকেই নিতে হবে। কারণ তাতে করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক যাই ফলাফল আসুক না কেন তার দায়ভার যে সম্পূর্ণ তোমার সেটি অবশ্যই ভালো করে বুঝতে হবে তোমাকে। আমার অনুরোধ থাকবে তুমি যা করেছ তা ভুল হয়েছে মনে করে এ ঘটনা থেকে শিক্ষাটুকু নাও যে জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি তুমি শ্রদ্ধা রাখবে কখনো কোনো অবস্থায় সচেতনভাবে কারও প্রতি, বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি অবিচার করবে না। আমাদের নৈতিক মূল্যবোধগুলো এভাবে হারিয়ে গেলে কী করে একটি সুস্থ সমাজ টিকে থাকবে বল তো?
অধ্যাপক ড· মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৯, ২০০৯
Leave a Reply