মেয়েটির বয়স ১৮। ফুটফুটে চেহারা। সব সময় হাসিখুশি। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, এই মেয়েটির জীবনে কোনো দুঃখ থাকতে পারে। একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, মেয়েটি কৃত্রিম পায়ে ভর করে হাঁটছে। তার একটি পা নেই। কিন্তু মেয়েটির কাছে এটা কোনো দুঃখের ঘটনা নয়। তার দুঃখ হলো, সে জানে না কে তার মা, কে তার বাবা। খুব ছোটবেলায় যে মানুষটি নিজের পরিচয় গোপন করে তাকে বিভিন্ন উপহার এনে দিতেন, তিনিই নাকি তার বাবা। তিনি কোথায় আছেন? জানতে ইচ্ছে করে বেঁচে আছেন কি না। এই মেয়েটি দেড় বছর ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত রাজশাহী মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসনকেন্দ্র সেফ হোমে রয়েছে। হোমের লোকেরা তার নাম দিয়েছে সামিরা। তবে সামিরা মনে করে, ছোটবেলায় তার নাম ছিল সুমাইয়া। তার যতদূর মনে পড়ে, তখন সে চট্টগ্রামের একটি শিশুসদনে ছিল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে জানত তার বাবা-মা কেউ নেই। তবে মাঝেমধ্যে সেই শিশুসদনে একটি লোক তাকে বিভিন্ন উপহার দিয়ে যেতেন। একদিন ওই সদনের কে যেন তাকে জানিয়ে দেন, উপহার দিয়ে যাওয়া মানুষটিই তার বাবা। সত্যি একদিন লোকটি এসে তাঁকে নিজের পরিচয় দেন। সেই বাবা একদিন এসে তাকে বলেন, ‘তোমাকে ভালো একটা পরিবেশে নিজের মতো করে মানুষ করব।’ সামিরা কোনো দিন বাবা-মায়ের আদর পায়নি। নিজের বাবা আছে। এখন থেকে সে বাবার কাছেই থাকবে। এসব চিন্তায় আচ্ছন্ন সামিরা সেদিন অভিভূত হয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে সে ভুলে যায় মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। শিশুসদন থেকে বের হয়ে সামিরা দেখে তাদের জন্য দুটি গাড়ি অপেক্ষা করছে। সামনেরটায় তাকে তুলে দিয়ে বাবা পেছনের গাড়িতে ওঠেন। সামিরা জানায়, চট্টগ্রাম কালুরঘাট ব্রিজের কাছে গিয়ে তার গাড়িটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। এরপর আর তার জ্ঞান ছিল না। বাবার গাড়িটাও দুর্ঘটনার শিকার হয় কি না, সে তাও জানতে পারেনি।
যখন পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে তখন সে বুঝতে পারে তার একটি পা নেই। চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতের মাদ্রাজের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। কে কীভাবে তাকে নিয়ে যায় বুঝতে পারেনি সে। হাসপাতালে সে দেখে সব অচেনা মানুষ। অচেনা ভাষায় কথা বলছে। পরে সে বুঝতে পারে, মাদ্রাজের একটি হাসপাতালে তাকে রাখা হয়েছে। সেখানে তাকে একটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কোনো অভিভাবক না থাকায় তাকে স্থানীয় একটি শিশুসদনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সামিরার হিসাবমতে, সেখানে প্রায় চার বছর তাকে থাকতে হয়। সেখানে সে অন্য শিশুদের সঙ্গে কাপড়ে ফুল তোলা ও নকশা তৈরির কাজ শেখার পাশাপাশি হিন্দি ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলে। এখনও বাংলার চেয়ে হিন্দি বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
সামিরা জানায়, সেখান থেকে তাকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। বিমান থেকে নামার পরও তার সঙ্গে লোক ছিল। তিনি তাকে বগুড়া রেলস্টেশনে নিয়ে এসে ‘চা খেয়ে আসি’ বলে হারিয়ে যান। সেখান থেকে সে পুলিশের হেফাজতে চলে আসে। বগুড়া সদর থানায় ২০০৮ সালের ৬ জানুয়ারি তার নামে জিডি করা হয়। জিডি নম্বর ৫৮০। এরপর বগুড়া চিফ জুডিশিয়াল আদালতের মাধ্যমে ২১ জানুয়ারি তাকে রাজশাহীর বায়ায় অবস্থিত এই সেফ হোমে পাঠানো হয়।
১ আগস্ট সেফ হোমে কথা হয় সামিরার সঙ্গে। সে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তবে হিন্দিতেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ। সেফ হোমের অফিস সহকারী ইখতিয়ার বলেন, মেয়েটির জীবন বড় রহস্যময়।
তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না তার বাবা কেন পরিচয় গোপন করে তাকে উপহার দিয়ে যেতেন। আবার যখন নিয়ে যেতে এলেন, তখন মেয়েটিকে আলাদা গাড়িতে দিয়ে নিজে পেছনের গাড়িতে উঠলেন। আর মেয়েটির গাড়িই বা কেন দুর্ঘটনার শিকার হলো। এটা কি তার কথিত বাবার কোনো ষড়যন্ত্র ছিল? তা-ই যদি হবে তাহলে কেন তিনি বাচ্চার জন্য উপহার কিনে দিতেন? তাকে এত টাকা খরচ করে কেনই বা চিকিৎসার জন্য ভারত পাঠালেন। আবার ভারত থেকে এনে কেনই বা ফেলে গেলেন। এসব রহস্যের কোনো জবাব মেলে না।’
হোমের পরিচালক আলহাজ সদর আলী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি কোনোভাবে মেয়েটির বাবার সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু আমরা কোনো কিনারা করতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘ফুটফুটে এ মেয়েটির মুখের দিকে তাকানো যায় না। হয়তো মেয়েটির বাবা-মা দুজনই আছেন। তাঁরা হয়তো জানেন না মেয়েটি এই সেফ হোমে একটি কৃত্রিম পা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।’
১ আগস্ট সামিরা এ প্রতিবেদককে বলে, ‘ছোট্টবেলায় আব্বুকে অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। এর পরও মনে হয়, আব্বুকে দেখলে আমি চিনব।’
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০০৯
Leave a Reply