বিয়ের পর প্রচলিত বেশ কিছু লোকাচার পালন করে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর এলাকার মানুষ। এসব লোকাচারের একটি ‘ভাদরকাটানি’। দীর্ঘকাল ধরে এটি এ অঞ্চলে উৎসবের আমেজে ও ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়।
‘ভাদরকাটানি’ উৎসব পালনে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক নববধূকে ভাদ্র মাস শুরুর আগেই স্বামী-শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উৎসব উপলক্ষে কোনো নববধূ তিন দিন, কেউ সাত দিন, আবার কেউ কেউ পুরো মাসটাই থেকে যান বাবার বাড়িতে। তবে অধিকাংশ নববধূই ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন বা সাত দিন কাটিয়ে ফিরে যাবেন শ্বশুরবাড়িতে। আর এ সময় নববধূরা স্বামীর মুখ দেখতে পারবেন না বা দেখতে দেওয়া হবে না! দেখা-সাক্ষাৎ হলে তাঁদের স্বামীরা অন্ধ হয়ে যেতে পারেন, সংসারের অমঙ্গল হবে, নয়তো অপঘাতে স্বামীর মৃত্যু হতে পারে! এ কারণে বাবার বাড়ির লোকজন ভাদ্র শুরুর এক দিন আগেই শ্রাবণ মাসের শেষে তাদের মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়! এটাই এ অঞ্চলের প্রচলিত লোকজ বিশ্বাস।
প্রচলিত এমন বিশ্বাসের কারণেই ভাদরকাটানি উৎসবের শুরু। ভাদরকাটানি এক ধরনের লোকাচার হলেও এটি এখন গোটা উত্তরাঞ্চলে হয়ে উঠেছে সামাজিক উৎসব। এ অঞ্চলের সমাজে ভাদরকাটানির ইতিবাচক একটি দিকও অবশ্য আছে। মেয়েকে সাত দিনের জন্য পেয়ে পরিবারগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়। এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ে এ উৎসবটি চলে আসছে শত বছর ধরে। নববধূদের ক্ষেত্রে এই ভাদরকাটানির সামাজিক রেওয়াজটি অবশ্যই পালন করতে হবে বলে এ এলাকায় প্রচলন আছে। পুরোনো গৃহবধূরা এই রেওয়াজটি এখনো মেনে চলছেন। ভাদরকাটানির এ প্রবণতাটি শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি।
সদর উপজেলার মাগুড়া প্রধানপাড়া গ্রামের মসলিমা বেগম (২২), মমতাজ বেগম (২০), ধনীপাড়ার লায়লা আনজুমান বেগম (২২), মোকছেদা (২০) ও লিপি (২২)-সবার নতুন বিয়ে হয়েছে। তাঁরা এখন বাপের বাড়িতে। ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখা ও কথা বলা থেকে বিরত থাকতেই তাঁরা বাপের বাড়িতে চলে এসেছেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে স্বামীর অকল্যাণ হয়, ক্ষতি হয়। একই কারণে মাগুরা প্রধানপাড়া গ্রামের ফারুক হোসেন ও আকতারুল ইসলামের নববিবাহিত স্ত্রীরাও তাই বাপের বাড়িতে চলে গেছেন।
মসলিমা বলেন, ‘ভাদরকাটানি বিষয়ে কোনো নিয়ম আছে কি না জানি না। তবে এ উপলক্ষে বাবার বাড়িতে বেশ কিছুদিন থাকা যায়। আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়। বেশ ভালোই লাগে।’ তিনি শ্রাবণ মাসের শেষ দিন বাপের বাড়ি এসেছেন।
লায়লা ও মকছেদা বলেন, ভাদরকাটানি সম্পর্কে তাঁরা বেশি কিছু জানেন না। তবে এ সময় বাড়িতে এসে সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার একটা সুযোগ পাওয়া কম কিসে! নিজেরও ভাদরকাটানি করতে হয়েছে উল্লেখ করে মসলিমার মা মাহমুদা বেগম বলেন, ‘মানিলে মানিক মিলে, না মানিলে অধোগতি হয়। তিন দিন স্বামীর মুখ দেখি বা নাই; দেখিলে স্বামীর চোখ কানা হয়।’
পঞ্চগড় নুরুল আলা নূর কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও নিকাহ রেজিস্ট্রার আবদুর রহমান জানান, ধর্মীয়ভাবে এমন কোনো বিধান নেই। ভাদরকাটানি কুসংস্কার হলেও রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বোদা উপজেলার বনগ্রাম এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি প্রসন্ন কুমার অধিকারী বলেন, ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দর্শন করলে সংসারে অমঙ্গল হয়-এ রকম বিশ্বাস থেকেই মানুষ আবহমানকাল থেকে ভাদরকাটানি উৎসব পালন করে আসছে।
তবে পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি আ ন ম আবদুল করিম বলেন, প্রতিটি দিনক্ষণই শুভ। ভাদরকাটানি একটা কুসংস্কার।
শহীদুল ইসলাম, পঞ্চগড়
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০০৯
Leave a Reply